ভারত উপমহাদেশে ইলমে ওহির চর্চা ও বিকাশের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের হলেও তা বিশেষ মাত্রা অর্জন করে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবির (রহ.) মাধ্যমে। তার পুত্র শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবির (রহ.) হাত ধরে তা আরো সুদৃঢ় হয়।

১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দ ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলায় প্রতিকূল পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ হয়ে ওঠে সেই ধারার ইলমে ওহির এক নজিরবিহীন মোহনা। ইলহামের ভিত্তিতে হয় এর প্রতিষ্ঠা। তৈরি হয় উসুলে হাশতেগানা বা মূলনীতি অষ্টক।

সেই মূলনীতির আলোকে দারুল উলুম দেওবন্দের পদাঙ্ক অনুসরণে সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার থানাধীন রেঙ্গা পরগনায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইলমে ওহির অন্যতম আরেক বিরাট প্রতিষ্ঠান জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা।

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা’র ২০১৯ -এ এসে ১০০ বছর পূর্তি হয়েছে। শতবর্ষে জামেয়া সৃষ্টি করেছে হাজারো আলেম, শাইখুল হাদিস, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, লেখক, গবেষক, সম্পাদক, সাহিত্যিক, সংগঠক, বক্তা, হাফিজ ও কারি ইত্যাদি।

তাদের মূল্যায়নে এবং শতবছর পূর্তি উপলক্ষে ‘শতবার্ষিকী সমাবর্তন ও দস্তারবন্দী মহাসম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হবে ২৫-২৬-২৭শে ডিসেম্বর। মহাসম্মেলনে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দুই শতাধিক ওলামা-মাশায়েখের উপস্থিতিসহ ৫লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সমাগমের আশা করছেন আয়োজকরা।

মহাসম্মেলনে প্রকাশিত হবে কালো হরফের বর্ণমালায় হাজার পৃষ্ঠায় সজ্জিত ঐতিহাসিক এক ‘স্মারকগ্রন্থ’। সম্মেলন সফল করতে জামেয়ার আসাতেজায়ে কেরাম, ফুজালা, আবনা, ছাত্র, পরিচালনা কমিটি ও এলাকার জনসাধারণ অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সম্মেলনের বিশেষ আকর্ষণ, উত্তীর্ণ মাথায় পরিয়ে দেয়া হবে দস্তারে ফজিলত।

শতবর্ষ পূর্তি সম্মেলনে এই মাদরাসা থেকে পাশ করা ৪ হাজার ‘মাওলানা’ ও ‘হাফেজ’কে সম্মানসূচক পাগড়ি প্রদান করা হবে। ইতিমধ্যে ভারত, ইংল্যান্ড, আফ্রিকা ও ইউরোপ থেকে অনেক অতিথি বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন।

দস্তারে ফজিলত কী ও কেন?

ফারসিতে দস্তার এবং আরবি ইমামা শব্দকে বাংলা ভাষায় পাগড়ি বলে। সাধারণত মাথায় জড়িয়ে লম্বাটে আকারের যে কাপড় পরিধান করা হয় সেটিই পাগড়ি (আল-কামুসুল মুহিত)।

ইসলামি পরিভাষায় : টুপির চারদিকে জড়ানো দীর্ঘ বস্তুকে পাগড়ি বলে। পাগড়ি মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী এক বিশেষ পোশাক। ইরান, তুরস্কসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাগড়ি শব্দের ব্যবহার আছে। তবে আরবিতে ইমামা শব্দটি বহুল প্রচলিত, সঠিক অর্থে শুধু টুপির চার পাশে জড়ানো বস্ত্রকে বলা হয় ‘আমামা’।

পরবতীর্তে শব্দটি শিরোভূষণকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। এজন্য মুসলিমদের প্রভাবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও পাগড়ির আকারে অন্যকিছু ধারণ করার রেওয়াজ আছে। কিন্তু ইসলামের পাগড়ি এসব থেকে স্বতন্ত্র, আলাদা।

ইসলামে পাগড়ির আকার আকৃতি এবং মাথায় বাঁধার নিয়ম-পদ্ধতি যেমন আলাদা, তেমনি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সিলসিলা এবং মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যের দিক বিবেচনায়ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। পাগড়ির যেমন একটা বাহ্যিক পবিত্র জৌলুস আছে তেমনি তার অন্তর্নিহিত প্রণোদনাও কম নয়। যারা তা অনুধাবন করেছেন তারা নিঃসন্দেহে উপলব্ধ হবেন। পাগড়ি পরার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক।

কারণ মহানবী (সা.) পাগড়ি ব্যবহার করতেন। শুধু তাই নয়, মানবজাতির পিতা হযরত আদমকে (আ.) ভূ-পৃষ্ঠে নেমে আসার সময় হজরত জিব্রাঈল (আ.) পাগড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি হযরত আদম (আ.) থেকে নিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত অধিকাংশ নবী-রাসুল পাগড়ি ব্যবহার করেছেন বলে হাদীস ও ইতিহাসের বর্ণনায় পাওয়া যায়।

সুতরাং পাগড়ি শুধু মহানবীর (সা.) সুন্নত নয়; বরং এটি সুন্নতে আম্বিয়া তথা নবীগণের সুন্নত। (যারকানী খ- : ৬,পৃষ্ঠা ২৭৮)।

মহানবী সা. ইরশাদ করেন, ‘পাগড়ি আরবদের (মুসলমানদের) মুকুট। যখন তারা পাগড়ি পরিধান করা ছেড়ে দেবে, তখন তারা ইজ্জত হারাবে।’

মহানবী (সা.) আরও ইরশাদ করেন, ‘আমাদের এবং মুশরিকদের মধ্যে পার্থক্যমূলক পরিচিতি হচ্ছে টুপির ওপর পাগড়ি পরিধান করা। কিয়ামত দিবসে পাগড়ির প্রতিটি প্যাঁচের পরিবর্তে নূর প্রদান করা হবে।’ (কানজুল উম্মাল খ- : ১৫ পৃ : ৩০৬)।

পাগড়ি এটি শেয়ারে ইসলাম বিধায় উপযুক্ত ব্যক্তিকে পরতে হবে। এক্ষেত্রে আল্লামা আশরাফ আলি থানবি (রহ.) বলেছেন, ‘পাগড়ি সেই মাথায় ধারণ করবে যার সুন্নাত ছুটে যাওয়ার সাধারণত সম্ভাবনা নেই এবং মাকরুহ কাজ করবে না বলে নিজের ওপর আস্থাশীল।’

ফুকাহায়ে কেরামের কেউ কেউ বলেছেন, ‘ভালোমত দাঁড়ি গজার আগে পাগড়ি না পরাই অধিক শ্রেয়।’ (আল ইলমু ওয়াল ওলামা-উর্দু)।

পাগড়ি এবং লাঠি ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ দুটি বৈশিষ্ট্য মুত্তাকি বয়স্ক বুজুর্গ আলেমরই পরিধান করা উচিত।

মাদ্রাসা পরিচিতি….

প্রতিষ্ঠাকাল : ১৩৩৮ হিজরি মোতাবেক ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ। অবস্থান : সিলেট শহর থেকে ১৩ কি.মি. দক্ষিণে রেল লাইন ও সিলেট-মৌলভী বাজার হাইওয়ে সংলগ্ন মোগলাবাজার রেলস্টেশনের সন্নিকটে।

প্রতিষ্ঠাতা : শায়েখ মাওলানা আরকান আলী রহ.। রূপকার : বিশিষ্ট তাফসির বিশারদ,খলিফায়ে সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. মাওলানা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রহ.। মুহতামিম : মাওলানা শায়খ মুহিউল ইসলাম বুরহান।

শিক্ষাবোর্ড : আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এবং আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তালীম বাংলাদেশ। শিক্ষাস্তর : ১. নুরানি (কিন্ডারগার্টেন) শাখা। ২. হিফজ শাখা । কিতাব বিভাগ. ৩. ইবতেদায়ি । ৪. মুতাওয়াসসিতাহ (নিম্ন মাধ্যমিক)। ৫. সানোবিয়্যাহ (উচ্চ মাধ্যমিক)। ৬. ফজিলত (স্নাতক)। ৭. তাকমিল (মাস্টার্স)।

ছাত্র সংখ্যা : প্রায় ২০০০জন। কর্মচারী : ১০ জন। শিক্ষাসমাপনকারী ফাজিল : দাওরায়ে হাদিস ও হিফজসহ প্রায় পাঁচ হাজার। সংগঠন : তাওয়াক্কুলিয়া ফুজালা ও আবনা পরিষদ।

লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও ফাজিল, জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা, সিলেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *