করোনাভাইরাস এখন আর চীনে আটকে নেই, ছড়িয়েছে আর সত্তরটি দেশে- এমনকি সিলেটেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধিন। 

পুরো বিশ্বই এখন এই ভাইরাসকে রুখে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সচেতনতা এবং সতর্কতাই এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। কথা বলা, হাঁচি, কাশির সময় মুখ থেকে বের হওয়া ছিটেফোঁটা থেকেই ছড়ায় এই ভাইরাস। আক্রান্ত কারও মুখ থেকে সেই ছিটে যদি হাতে এসে লাগে, তারপর সেই হাত যারই মুখ, নাক, চোখের সংস্পর্শে আসবে, তারই সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

করোনা ভাইরাস কী?
করোনা ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। এটি এক ধরনের করোনা ভাইরাস। ভাইরাসটির অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যে ‘মিউটেট করছে’, অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। ফলে এটি আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সোমবারই বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন, এ ভাইরাস একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে ছড়াতে পারে।

কতটা ভয়ংকর এই ভাইরাস :: 
এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। তবে এর পরিণামে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে। এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের দুই শতাংশ মারা গেছেন, হয়তো আরও মৃত্যু হতে পারে। তাছাড়া এমন মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে যা চিহ্নিত হয়নি। তাই এ ভাইরাস ঠিক কতটা ভয়ংকর, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এক দশক আগে সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল এক ধরনের করোনা ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি মানুষ। আর একটি ভাইরাসজনিত রোগ ছিল মিডল ইস্টার্ন রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা মার্স। ২০১২ সালে এতে মৃত্যু হয় ৮৫৮ জনের।

করোনা ভাইরাসের লক্ষ্মণ :: 
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ হলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, জ্বর এবং কাশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তারপর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং তখনই কোনও কোনও রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। 

যেভাবে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস :: 
মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।
তবে ঠিক কীভাবে এর সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারেরনি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সম্ভবত কোনও প্রাণী এর উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই প্রথমে ভাইরাসটি কোনও মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। এর আগে সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রথমে বাদুড় এবং পরে গন্ধগোকুল থেকে মানুষের দেহে ঢোকার নজির রয়েছে। আর মার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল উট থেকে।
করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে উহান শহরে সামুদ্রিক একটি খাবারের কথা বলা হচ্ছে। শহরটির একটি বাজারে গিয়েছিল এমন ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।  ওই বাজারটিতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো
কিছু সামুদ্রিক প্রাণী যেমন বেলুগা জাতীয় তিমি করোনা ভাইরাস বহন করতে পারে। তবে উহানের ওই বাজারে মুরগি, বাদুড়, খরগোশ এবং সাপ বিক্রি হতো।

এর চিকিৎসা কী?
ভাইরাসটি নতুন হওয়াতে এখনই এর কোনও টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। এমনকি এমন কোনও চিকিৎসাও নেই, যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে মানুষকে নিয়মিত হাত ভালোভাবে ধোয়া নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে। হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা এবং ঠান্ডা ও ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকারও পরামর্শ দিয়েছে তারা। এশিয়ার বহু অংশের মানুষ সার্জিক্যাল মুখোশ পরা শুরু করেছে।
আপাতত প্রতিকার হিসেবে এ ভাইরাস বহনকারীদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে বলছেন বিজ্ঞানীরা। ডাক্তারদের পরামর্শ, বারবার হাত ধোয়া, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা ও ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরা।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গ্যাব্রিয়েল লিউং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এ নির্দেশনায় বলছেন, হাত সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, বারবার হাত ধুতে হবে। হাত দিয়ে নাক বা মুখ ঘষবেন না, ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরতে হবে। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে মুখোশ পরুন, আর নিজে অসুস্থ না হলেও, অন্যের সংস্পর্শ এড়াতে মুখোশ পরুন।’

এদিকে, মরণঘাতি এই ভাইরাস প্রতিরোধে সবার আগে সতর্ক থাকতে হবে হাত ধোয়ার বিষয়ে। সবকিছুই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে করতে হবে। যাদের ঠান্ডা লেগেছে, হাঁচি-কাশি হচ্ছে, তাদের থেকে দূরে থাকবেন। আর মাস্ক তো পরবেনই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করলেই যে আপনার হাতের সব জীবাণু উধাও হয়ে যাবে, তাও সঠিক নয়। জেনে নিন হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম-
* পরিষ্কার পানিতে প্রথমে হাত ভিজিয়ে নিন। এবার কনুইয়ের সাহায্যে কলটা বন্ধ করুন। হাত দিয়ে কল বন্ধ করলে সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়।
* সাবানের সাহায্যে হাতে ও আঙুলে ফেনা তৈরি করুন।
* খেয়াল রাখবেন, ফেনা যেন হাতের পেছন দিক, আঙুলের ফাঁক ও নখের নিচ পর্যন্ত পৌঁছায়।
* অন্তত ২০ সেকেন্ড দুটি হাত ঘষা জরুরি। এর ফলে হাতের ময়লা, ত্বকের মাইক্রোবগুলো উঠে যায়।
* হাত ঘষে ধোয়া শেষ হলে আবারও পরিষ্কার পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন।
* শুধু নিজে ব্যবহার করেন, এমন পরিষ্কার তোয়ালেতে হাত মুছে নিন বা এয়ার-ড্রাই করে নিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *