আমাদের সমাজে রয়েছে এমন কিছু কুসংস্কার যা একটা মেয়ের বাবাকে তিল তিল করে মৃত্যু পথযাত্রীর দিকে ঠেনে নেয়। আমরা একটি নোংরা সংস্কৃতির সমাজে বসবাস করছি ও বুকে ধারন করে লালন করছি, যে সমাজে আমরা মুখে বলি যৌতুক একটি অপরাধ, কিন্তু যৌতুকের চেয়ে বেশি অর্থ অপচয় করতে হচ্ছে একটা মেয়ের বাবাকে।বিয়ের সময় ৩/৪ লক্ষ্য টাকার ফার্নিচার ১ লক্ষ্য টাকার মত রুমের আসবাব পত্র।
বিয়ের খানা খরচ ২ লক্ষাধিক, বিয়ের পর মেয়ের শশুর বাড়ির চৌদ্দ গোষ্টিকে দাওয়াত খাওয়ানোর সঙ্গে ১৪ গৌষ্টির জন্য কাপড় দেয়া।বিয়ের সময় ৩/৪ লক্ষ্য টাকার ফার্নিচার ১ লক্ষ্য টাকার মত রুমের আসবাব পত্র।
এমন কতোই না কুসংস্কার আমাদের সমাজে চলমান। এরই মধ্যে ইফতারি নামের এক কুপ্রথা অন্যতম।
“শ্বশুরবাড়ীর ইফতারি সামাজিক বন্ধন নয়, বরং সামাজিকতার নামে একটা মেয়ের বাবার উপর এক নীরব অভিচার”যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে শ্বশুর বাড়ীর ইফতারি নামক এক সামাজিক নীরব অভিচার। শুধুমাত্র অভিচারই নয় একটা প্রচলিত কুসংস্কারও বটে। তারই ধারাবাহিকতায় যুগ যুগ ধরে এই নীরব অভিচারের বলি হয়ে আসছে একটা মেয়ের বাবা বা তার পরিবার।
একমাত্র ভুক্তভোগী পরিবার জানে এই কুসংস্কারের বলি হয়ে তারা কতটা জর্জরিত। জন্মের পর থেকে একটা মেয়ে পরিপূর্ণভাবে তার পরিবারের উপর নির্ভরশীল। বিয়ের আগ পর্যন্ত তার যাবতীয় খরচ তার পরিবারই বহন করে তাকে। ১৮ / ২০ টা বছর ভরণ পোষণ করে কোনরূপ প্রতিদান না নিয়েই একজন বাবা তার মেয়েকে পাত্রস্থ করে।
সেই বিয়েতে মেয়ের বাবাকে/অভিভাবক কে জামাই বাড়ির কত রকম আবদার নীরবে সহ্য করে মিটাতে হয়। আর শুধুই কি এখানে শেষ একটা মেয়ের বিহাহ সম্পন্নের পর আরো কত যুগ যে কতরকমের আবদার মেটাতে হয়, তার কোন সীমারেখা নেই।
বিয়ের সময় ছেলে পক্ষ কে ধুমধাম করে খাওয়াতে হবে তা জেনো বাধ্যতামূলক। সাথে ভালো ফার্নিচার ও দিতে হবে। ফার্নিচার বলতে রান্নাঘরের থালাবাসন থেকে শুরু করে সোফা,ফ্রিজ, আলমারি, পালং,চেয়ার-টেবিল,ড্রেসিং টেবিল, বেড আরও অনেক কিছু।এক কথায়, একটা ঘর সাজানোর জন্য যা যা লাগে সেই সব কিছু যেন ছেলের বিয়েতেই শশুর বাড়ি থেকে মূলধন হিসেবে নিতে চায়। আর এটা আমরা বিন্দু মাত্র লজ্জিত হয়ে চাইনা,বরং মনে করি এটা আমাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে।
আর তাই বিয়ে করে শশুরের কাঁধে চড়ে সভ্যতার নব যাত্রা শুরু করতে চায়। সাধ্য অনুযায়ী বরপক্ষের এসব আবদার মিটিয়ে দিয়েই বিয়ে হয়ে যায়।তাহলে কি বিয়ে হয়ে গেলেই মেয়েপক্ষ স্বস্তির নিঃস্বাস নিতে পারছে?মোটেই নাহ!
বরং বিয়ের প্রাথমিক ধাপ শেষ করে স্ব জ্ঞানে বাকি জীবন সিজন ভিত্তিক অভিচার মেয়ে পক্ষকে সহ্য করে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আর সেই বন্দোবস্ত অনুযায়ী আপনাকে চলতেই হবে। আপনার বিভিন্ন উপঢৌকন নির্ভর করবে আপনার মেয়ে সুখে থাকার অবস্থা। মেয়ের সুখের জন্য মেয়ের অভিভাবক রা দিনের পর দিন শশুর বাড়ির এইসব জুলুম নীরবে সহ্য করেই যায় আর যাচ্ছেই এখনকার ঐ আধুনিক সমাজেও।
ইফতারি, নাইওরী,আম কাঠালী বাবার/পরিবারের বুকে সভ্য সমাজে অসভ্যতার গুলা বারুত… আমরা আধুনিক আর সভ্যতার স্লোগান দিচ্ছি, তবে মেয়ের বাবার প্রতি এই অভিচার কেন? রমজান মাস আর সিজন ভিত্তিক নাইওরীর সময় হলে বাবার বা পরিবারের চিন্তা বাড়তেই থাকে। মেয়েকে/বোন কে কিভাবে ইফতারি দেবে, কিভাবে ইফতারি/আম কাঠালী দেবে? ভালো করে ইফতারি /আম কাঠালী না দিলে মেয়েকে শশুরবাড়ি আর আশপাশের কটুকথা আর কতপ্রকার অসামাজিক অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে হবে। এক রমাযান মাসেই ২ বার ইফতারি আসা চাই। তাও আবার যেমন তেমন ইফতারি না।
আশপাশ যেভাবে জানে সেইভাবে আনত হবে। গর্ব করে যাতে আশপাশে বলতে পারা যায় এমন করে আনতে হবে। একটু কম হলেই মেয়ের কপালে বাকপন্ডিতার আঘাত আঘাত আর কালবৈশাখির ঝর অনিবার্য। এমন কি উদাহরণ দিয়ে বলতে থাকে, অমুকের ছেলের বউর ঘর ভর্তি ইফতারি এসেছে। সারাটা গ্রাম বিলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি আমার আত্নীয়কেই দিতে পারিনি। লজ্জায় আমি মুখ দেখাতেই পারছিনা। এরকম নানা কথা কোন কোন পরিবারে ছেলের বউকে শোনতে হয় প্রতিনিয়ত। কিন্তু কেন এই অসভ্যতা আর অবিচার? প্রশ্ন সচেতন মহলের। প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলেও তা পরিহার হচ্ছেনা এটাই সত্য।
এইসব ইফতারি কয়টা পরিবার স্বাচন্দে তার মেয়ের বাড়ি দিয়ে থাকে, হাতেগুনা কয়েক টা পরিবার পরে শুধুমাত্র মেয়ের/বোনের মুখ রক্ষার্থে সামাজিক এই কুপ্রথার ভার অনেক গুলা পরিবার অনাহাসে বয়ে যাচ্ছে। কোনরূপ আনন্দ ছাড়াই মেয়ে পক্ষকে যবাই হয়ে যাচ্ছে। সবচাইতে বেশী নির্মমতার স্বীকার সমাজের দারিদ্র্য ও মধ্যবিত্ত পরিবার গুলা। দারিদ্র্য পরিবার গুলা মেয়ের সুখের জন্য সুদে টাকা এনে হলেও মেয়ের বাড়ি ইফতারি দিতে হয়,বাধ্য। শশুর বাড়ী যখন ইফতারি খাওয়া আর বিতরণে ব্যস্ত,হয়তো সেই রাতে একটা মেয়ের বাবা চোখেরজলে বালিশ ভিজাচ্ছে।কিভাবে সে টাকা পরিশোধ করবে। সেই টাকার চিন্তা শেষ হতে না হতেই দেখা যায় আরেকটা আম-কাঠালী দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। উফফফ, কি নির্মমতা! এতে অনেকেই গৃহহারা ও হচ্ছেন বলে দেখা যাচ্ছে সচরাচর। অনেকেই মেয়ের শ্বশুর বাড়ি ইফতারি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেও ইতিহাস সাক্ষি দিচ্ছে৷ ব্যর্থ হয়ে কি আর ঘটনা এখানেই শেষ? মোটেও না! এই ব্যর্থতার প্রতিদান আত্মহত্যার মাধ্যমে দিতে হয়েছে কতশত তরুনীকে। সেদিন এমনই এক তরুনীর পরিবারের সাথে কথা হলো। আর মধ্যবিত্ত পরিবার তো নিজের সম্মান রক্ষার্থে নিজে এক মাস কষ্ট করে থাকবে।
তবুও মেয়ের বাড়ি ভালো করে ইফতারি দিতে হবে।না হলে কত লোক লজ্জায় তাদের আর তাদের মেয়ের কপালে থাকবে অজানা কতশত ঝড়। শুধু কি ইফতারি দিয়েই মেয়ে পক্ষ রেহাই পেয়ে যাচ্ছে।নাহ!। রমজান পরেই শুরু হয় সিজন ভিত্তিক বিভিন্ন নাইওরীর পালা। একটার পর একটা নাইওরী চলতেই আছে। আম কাঁঠাল নাইওরী,শীতকালীন পিঠা নাইওরী আরও অনেক কিছু। বিভিন্ন বিশেষ দিনে আরও কত কিছু ছেলের বাড়ি পাঠাতে হয়। হায় এ কেমন অভিচার? আপনি একটা মেয়েকে বিয়ে করেছেন নাকি আপনার ১৪গুষ্ঠীর খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব মেয়ের বাড়ির সাথে বন্দোবস্ত হয়েছে? সমাজের কিছু কিছু ভিত্তবান মানুষের বিলাসিতা বাকি হাজার টা পরিবারের সুখ জীবন থেকে কেড়ে নিচ্ছে। তাদের একেক টা বিলাসী কর্মকাণ্ড পরবর্তী হাজার পরিবারের নির্মমতার কারণ হচ্ছে। অনেকে বলে থাকেন এসব ইফতারি নাইওরী দিলে সামাজিক সম্পর্ক বাড়ে। পারস্পারিক মায়া মমতা বাড়ে। বাহ,এক পক্ষ সারা জীবন দিতেই আছে
সারা জীবন খেয়েই যাচ্ছেন। এতে সম্পর্ক বৃদ্বি হচ্ছেনা।বরং এই দেওয়ার অনন্তরলে লুকিয়ে থাকে হাজার হাজার অশ্রু আর মেয়ের জামাই বাড়ির প্রতি নীরব ঘৃণার জন্মাচ্ছে। যা মুখ ফুটে বলা হচ্ছেনা। আসুন, আপনার সিজন ভিত্তিক একদিনের নাইওরী আর ইফতারি খাওয়ার আনন্দ করে অন্য পরিবারের সারাটা মাস বছরের চিন্তার কারণ না হই। আপনি মেয়ে কে নিয়ে সুখে থাকুন,আর মেয়ের পরিবার কে এই সামাজিক অত্যাচার থেকে মুক্তি দিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে দিন। একটা বাবার মেয়েকে নিজের মেয়ে ভাবুন।
একবার চিন্তা করুন অন্তত এই বাবার এসব দেওয়ার সামর্থ্য কি আছে? নাকি আমাদের সমাজের চলতি কুপ্রিথার স্বীকার হয়ে বাধ্য হয়ে দিচ্ছে। অনেকেই এটা আমাদের সভ্যতা বলেও মনে করেন। কিন্তু আসলেই আমাদের সমাজের এটা কোন সভ্যতা না। বরং এটা সভ্য সমাজের জন্য একপ্রকার অসভ্যতা। আর ইসলামেও এ ব্যাপারে কোন বাধ্যতামূলক কিছু বলা হয়নি বরং অধিকার সংরক্ষনের কথা বলেছে
আবূ শুরাইহ্ খুওয়াইলিদ ইবনে আমর্ খুযায়ী (রা)বলেন,নবী সাঃ বলেছেন,”হে আল্লাহ! আমি লোকদেরকে দুই শ্রেণীর দুর্বল মানুষের অধিকার সম্বন্ধে পাপাচারিতার ভীতিপ্রদর্শন করছি,১) এতিম ও২) নারী।”ইবনু মাজাহ,হাঃ৩৬৭৮ যে ইফতারি দিতেই হবে। সুতরাং আসুন এই ইফতারি নামক কুপ্রথা পরিহার করি। সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই ইফতারি নামক কুপ্রথার কারনে কোন বোন কটু কথা শুনবে। আর কোন বাবা নীরবে অত্যাচারিত না হবে।

মোঃআব্দুর রহমান
সভাপতি
মানব কল্যান ফাউন্ডেশন বড়লেখা মৌলভীবাজার ।