ফেইসবুকে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ আপনি দেখলেন আপনার পরিচিত কারো আপত্তিকর ভিডিও অথবা আপনারই কোন স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত ছবি। এড্রেনালিনের শীতল প্রবাহ বয়ে যাওয়ার আগেই আপনি মুখ থুবড়ে পড়বেন এই সমাজের আস্তাকুঁড়ে। কেউ হয়তো জিজ্ঞেসও করবেনা সেটি আপনি কি না, কারণ তারা বিশ্বাস করবে এটিই আপনি। মজার ছলে হোক বা ফ্রেন্ডদের সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই হোক, আপনার আপলোড করা ছবি বা ভিডিওগুলোই অতি সন্তর্পণে হয়ে উঠতে পারে আপনার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন ধ্বংস করে দেয়ার মোক্ষম হাতিয়ার।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যথেচ্ছা ব্যবহারের সুবিধা এবং প্রদর্শনেচ্ছার জন্য আমরা অনেকটা নিয়মিতই আমাদের বিভিন্ন অঙ্গভংগির ছবি এবং ভিডিও শেয়ার করে থাকি। ধর্মীয় বিধিনিষেধ গুলোর কোন তোয়াক্কা না করেই আমরা এসব করি।

অথচ একটি স্বল্পমানের ডিপ ফেইক ভিডিও এক ঝটকায় আপনার জীবন এলোমেলো করে দিতে পারে। কারণ বেশিরভাগ মানুষ জানতে চাইবেনা এটা ফেইক কিনা। তাদের ফোকাস থাকবে চেহারার মিলের উপর আর ডিপ ফেইক ভিডিওগুলো ঠিক এটাই করে। যদি আপনি এমন কিছুর শিকার হোন, একবার চিন্তা করুন তো আপনার আর আপনার পরিবারের মানসিক অবস্থা কেমন হবে।

শুধু পারিবারিকই নয়, একটা ডিপ ফেইক ভিডিও বদলে দিতে পারে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, ভেঙে দিতে পারে আন্তরাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক বোঝাপড়া এমনকি যুদ্ধ লেগে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক না। কিন্তু যতক্ষণে মানুষ বুঝতে পারবে যে এই ভিডিওটি ফেইক ছিল ততক্ষণে আসল ক্ষতিটায় হয়ে যাবে।

তাই আমাদের জানতে হবে এই ডিপ ফেইক ভিডিও আসলে কি!

কিভাবে আমরা এই ধরনের ভিডিওগুলো সনাক্ত করতে পারি।

সহজ ভাষায় বললে ডিপ ফেইক প্রযুক্তি হলো এমন প্রযুক্তি যার মাধ্যমে তুলনামূলকভাবে সহজেই অডিও ও ভিডিও কনটেন্টের বিশ্বাসযোগ্য নকল তৈরি করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কৌশল ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ আপনাকে দেখা যেতে পারে কোন খুনের খুনীর দৃশ্যে, কোন চরমপন্থি সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে অথবা অসামাজিক কোন কাজে লিপ্ত অবস্থায়।

কিভাবে তৈরি হয়

ডিপ ফেইক ভিডিওর প্রধান অস্ত্র হলো AI enhanced Machine learning tools. এ পদ্ধতিতে একজন ক্রিয়েটর কোন ব্যাক্তির রিয়েল ভিডিও ফুটেজকে ব্যবহার করে একটি নিউরাল নেটওয়ার্ককে বেশ কয়েকঘন্টা যাবত ট্রেইনড করান যাতে এ আই রিসেপ্টরগুলো সে ব্যক্তির অবয়ব, অঙ্গভঙ্গি, ফেসিয়াল মাসল মুভমেন্ট, বিভিন্ন দিক থেকে আলোকদীপ্তি, লিপস ল্যাঙ্গুয়েজসহ আরো অনেক প্যারামিটারের ভেল্যুগুলো এক্যুয়ার করে আরেকজন ব্যক্তির মুখাবয়বের উপর সুপারইম্পোজ করতে পারেন।

তবে হ্যাঁ, কাজটা মোটামুটি জটিল। যতবেশি বাস্তবসম্মত দেখাতে হয়, ততবেশি প্যারামিটার ব্যবহার করতে হয় এবং ম্যানুয়ালি প্রোগ্রামগুলোকে ট্যুইক করে tellatale Bip গুলোকে যতটা সম্ভব কমাতে হয়।

অনেকে ভাবেন এই ডিপ ফেইক ভিডিওগুলো এডাভান্সড ফিকশনাল মোডের সফটওয়্যারগুলো দিয়ে করা হয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো এভাবে তৈরি ভিডিও গুলোর ইমেজ সিন্থেসাইজেশন ক্যাপিবিলিটি খুব কম এবং একটু মনোযোগ দিলেই এসব ধরে ফেলা যায়।

সাধারণত ডিপ লার্নিং এলগরিদম দ্বারা পরিচালিত Generated Adversial Network(GAN) এবং Autoencoder টেকনোলজি ব্যবহার করে খুব সুক্ষ্ণভাবে ইমেজ প্রসেসিং এবং ডেটা লাইনআপের মাধ্যমে এই ভিডিওগুলো তৈরি হয়।

এখন আপনার মনে হতে পারে এসবতো অনেক কঠিন তাই সবাই হয়তো পারবেনা। কিন্তু বাস্তবতা হলো বেশ কয়েকটি জায়ান্ট ইমেজ প্রসেসিং কোম্পানি ইতোমধ্যে তাদের প্রিমিয়াম বা পেইড ভার্সনে ডিপ ফেইক ভিডিওর টুলসগুলো যুক্ত করেছে। তাই স্বল্প এডিটিং নলেজের যে কেউই সামান্য চেষ্টায় কারো জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর মূহুর্ত ডেকে আনতে পারেন।

এটি কি সনাক্ত করা সম্ভব

ডিপ ফেইক ভিডিও সনাক্ত করার মত টুল এখনও অস্তিত্বহীন বলা চলে। তবে অ্যাকাডেমিক, সাংবাদিক এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গুগল ঘোষণা দিয়েছে, তারা অলটার্ড বা বিকৃত করা ভিডিও সনাক্তের জন্য একটি টুল তৈরি করছে। কিন্তু বলা হয়নি, সেটি কবে আসবে বা তার ক্ষমতা কী হবে।

মিউনিখের ভিজ্যুয়াল কম্পিউটিং ল্যাবের একটি দল তৈরি করেছে ফেস ফরেনসিকস্। প্রোগ্রামটি র’-ফরম্যাট (যে ফরম্যাটে ধারন করা) ফাইল থেকে ভিডিওর বিকৃতি সনাক্ত করতে পারে। তবে ওয়েবের জন্য সংকুচিত বা কমপ্রেস করা ভিডিওর বেলায় তারা সফল হননি।

ইতালির আরেকটি দল, এমন এক কৌশল প্রস্তাব করেছেন, যেখানে ভিডিওতে কোনও ব্যক্তির মুখমন্ডলে রক্ত প্রবাহে অনিয়ম দেখে বলে দেয়া যাবে, ছবির চেহারাটি আসল, নাকি কম্পিউটার জেনারেটেড।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষতিকর ব্যবহার নিয়ে এক সাম্প্রতিক গবেষণায়, ডিপ ফেইক ভিডিও তৈরির সফটওয়্যার লাইসেন্সিংয়ের আওতায় আনা এবং তার ব্যবহার সীমিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন একদল গবেষক। ইলেক্ট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং অন্য সদস্যদের নিয়ে গঠিত দলটি শুধু তাত্ত্বিক দিকে মনোযোগ দিয়েছে; মূলত বিষয়বস্তুর নতুনত্বের কারণে।

মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল ভেরিপিক্সেল নামে একটি প্রোগ্রাম তৈরি করছে, যা ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে স্মার্টফোন ও ক্যামেরায় তোলা ছবির মূল ফাইলে একটি ‘ফুটপ্রিন্ট’ বা চিহ্ন জুড়ে দেয়।

ডেভেলপারদের একজন উইলিয়াম ফ্রাইস বলেন, “আপনার এমন একটি পদ্ধতি দরকার যা বলবে, হ্যাঁ, এটাই আসল ফাইল। ব্লকচেইনের সুবিধা হল, যাই ঘটুক না কেন, ফাইলের ঐতিহাসিক তথ্য ঠিক থাকে।”

কিন্তু অন্যান্য প্রোগ্রামের মত ভেরিপিক্সেল এখনও নির্মানাধীন পর্যায়ে রয়েছে।

আপনি কিভাবে সনাক্ত করবেন

ডিপ ফেইক ভিডিওর মুখভঙ্গি থেকে অসঙ্গতি চিহ্নিত করার কিছু কৌশল বাতলে দেয়, “হাউ টু গিক” নিচের কিছু পয়েন্টের দিকে নজর দিতে বলেছে :

• ফ্লিকার (ভিডিওতে আলোর কম্পন বা ঝিলিক)

• চেহারা বা মুখের দিকটায় অস্পষ্টতা (ব্লার)

• অস্বাভাবিক ছায়া বা আলো

• অস্বাভাবিক নড়াচড়া, বিশেষ করে মুখ, চোয়াল এবং ভ্রুতে

• ত্বকের রঙ এবং শরীরের গড়নে অসামঞ্জস্য

• কথার সাথে মুখের নড়াচড়ায় অমিল

তাছাড়া আপনি রিভার্স ভিডিও মেকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রতিটি ফ্রেমকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করে ডিপ ফেইক ভিডিও সনাক্ত করতে পারবেন।

আর এসব জানা না থাকলে ব্যবহার করুন আপনার ক্রিটিক্যাল থিংকিং কে। কোন ভিডিও ফেইক মনে হলে প্রথমেই দেখুন

কারা কীভাবে ভিডিওটি শেয়ার করেছে। ফেইসবুকের ভাদাইম্মা গ্রুপগুলো করলে এড়িয়ে যান।

খুব মনোযোগ দিয়ে ভিডিওর ব্যক্তির মুখাবয়ব পর্যবেক্ষণ করুন। ঠোঁটের সাথে তার উচ্চারিত শব্দের সামঞ্জস্যতা দেখুন।

অনলাইনে ভিডিও যাচাইয়ের প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন invid এবং Amnesty YouTube Data Viewer ব্যবহার করে সন্দেহকৃত ভিডিওর সত্যতা যাচাই করুন।

ভিডিওর মেটাডাটা সে ভিডিও ধারণের তারিখ, ক্যামেরার ধরণ, ভিডিও ধারণের স্থানসহ অন্যান্য তথ্য প্রদান করে। Exiftool নামক একটি টুল এই কাজটি অনায়াসেই করতে পারে। ডাউনলোড করে ব্যবহার করুন।

সত্যিকার অর্থে বাস্তবতা হলো যারা এক্সপার্ট লেভেলের ফেইকার তারা এই মেটাডাটা, ছবির ফ্রেমের কনসিস্টেন্সি, লিপ্স ল্যাংগুয়েজ, এই সব কিছু আপনার সামনে একদম হুবহু হাজির করার ক্ষমতা রাখে।

উপরের পরামর্শগুলো এই জন্য যাতে rookie লেভেলের কেউ খুব স্বল্প দক্ষতায় আপনার বা আমার ব্যক্তিগত বিশাল ক্ষতি করতে না পারে।

সর্বোপরি, সিদ্ধান্ত হলো আপনার হাতে। কিছু ধর্মীয় বিধিনিষেধকে অবজ্ঞা করে আপনি শুধু আপনার আখিরাতই নষ্ট করছেন না, নষ্ট করছেন আপনার পার্থিব জীবনটাও। আপনি সেলেব্রিটি না , আপনি একজন সাধারণ মানুষ। একজন মুসলিম। আপনার উদ্দেশ্য এবং কর্মপন্থা আলাদা। আপনি এ পৃথিবীকে পাওয়ার জন্য আসেননি, এসেছেন এর ফিতনাকে জয় করে আপনার মূল বাসস্থানের হিসেব পাকা করতে।

যদি আপনি মনে করেন আপনার শেয়ার করা ছবি এবং ভিডিওগুলোর মাধ্যমে আপনার উদ্দেশ্য পুরণ হচ্ছে, তাহলে আপনাকে স্বাগতম।
লেখক: Shaquille Nashat

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *