চারপাশে জঙ্গল। এ জঙ্গলের ভেতরই টিলার পাদদেশে লুকিয়ে আছে তিন ঝরনা। ঝরনাগুলো স্থানীয়দের কাছে ‘ঝিরি ঝরনা বা অরণ্য ঝরনা’, ‘মরা ঝরনা’ ও ‘আদুরে ঝরনা’ হিসেবেই পরিচিত। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর এলাকায় কমলাবাড়িতে অবস্থান করছে ঝিরি ঝরনা বা অরণ্য ঝরনা। আর মরা ঝরনা ও আদুরে ঝরনা একই উপজেলার শ্রীপুর চা বাগানের ভেতর প্রায় অর্ধ কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থান করছে। ঝরনাগুলোকে ঘিরে প্রকৃতি তৈরি করেছে তার অপরূপ এক সৌন্দর্য। তবে এ তিন ঝরনাতেই পানির কোনো প্রত্যক্ষ উৎস নেই।
সরেজমিনে সিলেট থেকে ঝরনার খোঁজে রওনা হলে জৈন্তাপুর বাজারে গিয়ে বাঁ দিকে প্রবেশ করেছে কমলাবাড়ি এলাকা। এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলে চারপাশে জঙ্গলঘেরা একটি ঝরনা। ঝিরিঝিরি পানি, স্বচ্ছ জলরাশি। মাঝেমধ্যে পাখির ডাক। আর প্রকৃতির নীরবতা। প্রখর রোদ হলেও ঝরনার জলধারা যেন হিমশীতল করার মতো।
খানিক সময় দাঁড়ানোর পর গরু নিয়ে স্থানীয় আবুল কালাম নামের এক যুবকের আগমন। আঞ্চলিক ভাষায় জানতে চাইলেন, ‘ভাই কইনাকি আইছইন?’ উত্তর দেবার আগেই জানানো শুরু করলেন এ ঝরনাধারার বৈশিষ্ট্য। বলেন, ‘এটা নতুন না ভাই। আমার জন্মের পর থেকেই এরকম। বর্ষা হলে পানি বাড়ে, না হলে সারা বছরই ঝিরিঝিরি পানি পড়ে। সবাই ঝিরিঝরনা বলে ডাকে। কিন্তু পানি কোথা থেকে আসে কেউ জানে না।’

এবার রওনা অন্য ঝরনার খোঁজে। শ্রীপুর যাওয়ার আগে আদর্শগ্রাম। এখান থেকে বাঁ দিকে কাঁচা রাস্তা ধরে বাগানের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে সামান্য এগিয়ে অল্প উঁচু টিলায় উঠলেই দেখা মিলে অপর প্রান্তের ছোট একটি টিলার পাদদেশে একটি ঝরনা। স্বাভাবিকভাবে দেখে মনে হচ্ছিল ওপর থেকে কেউ অল্প অল্প করে পানি ঢালছে। আর এ ঝরনার নাম মরা ঝরনা। শ্যাম লাল নামের এক চা শ্রমিক জানান, বর্ষায় এরকম পানি পড়ে। কাজে এসে তারা এখান থেকে পানি পান করেন। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানি নাই হয়ে যায় বললে চলে। তবে শ্রমিকদের খাবার মতো পানি পাওয়া যায়। তাই এ ঝরনাকে চা শ্রমিকরা মরা ঝরনা হিসেবেই ডাকেন।

তবে মরা ঝরনা থেকে বের হয়ে দেখা মিলল জল গড়িয়ে পড়া এক ঝরনার। এ ঝরনাটিও শ্রীপুর চা বাগানের ভেতরই অবস্থান করছে। যাকে সবাই আদুরে ঝরনা হিসেবেই চিনে। শ্রীপুর পয়েন্ট থেকে পাঁচ থেকে ছয়শ’ গজ ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা মেলে এ ঝরনার। এখানে অবশ্য মানুষের আনাগোনাও আছে। ঝরনাটা ইতোমধ্যে স্থানীয়ভাবে কিছুটা পরিচিতিও পেয়েছে। মাধবকুন্ড বা অন্য কোনো ঝরনার মতো না হলেও এ ঝরনার সোন্দর্য কিছুটা ব্যতিক্রম। কারণ পূর্বের দুই ঝরনার মতো এখানেও নেই কোনো পানির উৎস।
তাই তো ঝরনার উপরের দিকে থাকা প্রচুর প্রাকৃতিক বন আর বিস্তৃত টিলার ঘাম থেকেই এর জলের উৎস হতে পারে বলে ধারণা স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণ ইমতিয়াজ নাহিদ ও খায়ের আব্দুল্লাহর। তাদের দাবি, উপজেলা প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নিলে এ তিন ঝরনা হতে পারে জৈন্তাপুর উপজেলার নতুন আকর্ষণ।
নতুন নতুন স্থানগুলোকে সংরক্ষণের মাধ্যমে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করা হবে বলে জানালেন জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুসরাত আজমেরী হক।
তবে পান-পানি-নারী খ্যাত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর জৈন্তাপুর উপজেলার পর্যটকের আকর্ষণ করার মতো এ তিন ঝরনাই না। উপজেলার ডিবির হাওরের লাল শাপলা বিলের পরিচিতি দেশজুড়ে। এবার এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন এই তিন ঝরনা।