প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট। ইউরোপ প্রবাসী নেই এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না সিলেট বিভাগে। তাই এ অঞ্চলের তরুণরাও ইউরোপ যাত্রার স্বপ্নে বিভোর। যে কোনভাবে তাদেরকে ইউরোপের কোন দেশে যেতে হবে- এ যেন তাদের আজন্ম স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রাণপ্রদীপ হারাচ্ছেন অনেকে। বিভিন্ন দেশে আটকে মুক্তিপণ হিসেবে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালালরা। এক সময় ইউরোপের স্বপ্ন ভেজে স্বজনদের কান্নার জলে। দালালদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া স্বজনরা শেষ পর্যন্ত ফিরে পাননা বিদেশ-বিভইয়ে নিখোঁজ হওয়া তাদের পরিবারের সদস্যটিকেও। সম্প্রতি সিলেটের এমন একটি দালাল চক্রের সন্ধান মিলেছে। ভক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ওইচক্রটি ইতালীতে পাঠানোর নাম করে লিবিয়ায় সিলেটের ২৫ তরুণকে জিম্মি করে রেখেছিল। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন সেদেশের পুলিশের গুলিতে। আর বাকি ২৪ জন কোথায় আছে তারও খোঁজ মিলছে না ৭-৮ মাস ধরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দালালচক্র সিলেটের প্রবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নিজস্ব এজেন্ট নিয়োগ দেয়। অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোতে গিয়ে এজেন্টরা শুভাকাঙ্খি সেজে তাদের পরিবারের তরুণ সদস্যটিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠাতে উদ্ধুদ্ধ করে। তাতে পরিবার রাজি হলে তাদেরকে দালালের ঠিকানা ধরিয়ে দেয় এজেন্ট। এরপর দালালচক্রের সদস্যদের সাথে চলে ইউরোপ যেতে আগ্রহীদের চুক্তি।

ভক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ২৫ জন তরুণকে ইউরোপের দেশ ইতালীতে পাঠানোর চুক্তি করে ফরহাদ সিন্ডিকেট। আদমপাচারকারী ওই চক্রের প্রধান ফরহাদ আহমদ। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার ঈদগাহবাজারের বাসিন্দা ফরহাদ বর্তমানে পর্তুগাল থাকেন। সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন পুরো সিন্ডিকেটের কার্যক্রম। তার সিন্ডিকেটে তার স্ত্রী, মা ও বোনসহ পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। ১০-১২ লাখ টাকায় বাংলাদেশ থেকে দুবাই ও লিবিয়া হয়ে ইতালীতে পাঠানোর চুক্তি করেন তারা। চুক্তি অনুযায়ী তাদেরকে লিবিয়া পর্যন্ত নেয়া হয়। সেখান থেকে ট্রলারে করে তাদেরকে ইতালী পাঠানোর কথা। কিন্তু লিবিয়ায় নেয়ার ওই তরুণদের জিম্মি করে তাদের পরিবারেরর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। একের পর এক দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় তাদেরকে। দালালের হাত বদলের সাথে বাড়তে থাকে টাকার পরিমাণ। নতুন দালাল তাদেরকে জিম্মি করে দেশের স্বজনদের টাকা পাঠাতে বাধ্য করে।

বিয়ানীবাজারের ভক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, দালালদের মাধ্যমে যে ২৫ জন তরুণ ইতালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়া পর্যন্ত গেছেন গেল প্রায় ৪ মাস ধরে তাদের কোন খোঁজ মিলছে না। এর মধ্যে লিবিয়ার ত্রিপোলীর একটি জেল থেকে পালানোর সময় এক তরুণ মারা গেছে। অপর একজন জেল থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু জেল থেকে বের হওয়ার পর সে আবার আরেক দালালের কাছে আটক হয়। ওই দালাল মুক্তিপণ বাবত পরিবারের কাছে থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আদায় করেছে। এখন ওই তরুণেরও খোঁজ মিলছে না।

লিবিয়ায় নিখোঁজ তরুনের এক আত্মীয় জানান, দালালের সাথে চুক্তি ছিল গন্তব্যে পৌঁছার আগে কোথাও পুলিশের হাতে আটক হলে দালাল তার নিজ দায়িত্বে ও খরচে সে মুক্ত করবে। কিন্তু লিবিয়ায় যাওয়ার পর দালালরা চুক্তির কোন কিছুই মানছে না। তারা নানা অজুহাতে শুধু টাকাই নিয়েছে।

বিয়ানীবাজার উপজেলার পূর্ব লাউঝারী গ্রামের আতিকুর রহমান জানান, তার ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুনও দালালের মাধ্যমে ইতালীতে যেতে চেয়েছিল। বর্তমানে সে লিবিয়ায় নিখোঁজ রয়েছে। দালালকেও এখন ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফোন বন্ধ রয়েছে। তার ছেলেসহ এলাকার যারা ইতালী যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় অবস্থান করছিল গত চারমাস ধরে তাদের কোন খোঁজ নেই। তবে তাদের ধারণা ওই তরুণরা হয়তো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে লিবিয়ার কোন জেলে বন্দি আছে। তারা বেঁচে আছে। এখন সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদেরকে মুক্ত করে দেশে ফেরানো সম্ভব নয়।

লিবিয়ায় নিখোঁজ থাকা সিলেটের বিয়ানীবাজারের তরুণরা হলেন- পূর্ব লাউজারী গ্রামের তানহারুল ইসলাম, একই গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মামুন, হোসেন আহমদ, আব্দুল্লাহ আল জুনেদ, আরিফ আহমদ দুলাল, খশিরবন্দ (হাতিটিলা) গ্রামের তোফায়েল আহমদ, রাজু আহমদ, একই গ্রামের এনামুল হক, খশির কোনাপাড়া গ্রামের কামরুজ্জামান রাহাত, ঘুঙ্গাদিয়া নয়াগাঁও গ্রামের আব্দুল আজিজ, একই গ্রামের আহমদ অজিত, গড়রবন্দ গ্রামের আব্দুল করিম। এছাড়া বিয়ানীবাজারের আমিনুর রহমান নামের এক যুবক লিবিয়ায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *