জগৎ সংসারে এমন কিছু অসাধারণ গুণসম্পন্ন মানুষ আছেন,যারা সাধারণ মানুষের সাথে অতি সাধারণ- ভাবে মিশে থাকেন বলে সহজে তাদেরকে চেনা যায়না। আর যখনই কোন সূত্রে তাদের সাথে পরিচয় ঘটে,তখন মনে হয়,পরিচয়টা কেন আরও আগে হলো না! তেমনি এক অসাধারণ গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী জনাব আবু সিদ্দিকুর রহমান স্যার (পরিচালক- ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়)।

তিনি যখন ইফা,সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক, তখন ফিল্ড সুপার হিসেবে চাকুরীতে আমার যোগদান এবং তার সাথে প্রথম পরিচয়। তখন বয়স ছিল কম এবং চাকুরির ‘ঠান্ডা-গরম’ ততোটা বুঝিনি বলে বোধহয় চাকুরী ক্ষেত্রে শুধু উদাসীনই নয়,কিছুটা উড়ুক্কু স্বভাবের ও ছিলাম আমি। শুধু আমি না,আমার মত আরও অনেক উড়নচণ্ডীদের তিনি তখন সামলেছিলেন বড় ভাইয়ের স্নেহময়তা দিয়ে, ঠান্ডা মাথায়।

সাধারণত “যত বড় কর্মকর্তা, কাজ তত কম” বাংলাদেশের অফিস পাড়াগুলোতে এটা এক অলিখিত নিয়ম। এ নিয়মের বাইরে ছিলেন তিনি। কতটা বাইরে, একটামাত্র উদাহরণ দেই- অফিস সময়ের পুরোটা তিনি কাজের মধ্যে-তো ডুবে থাকতেনই ; কখনো কখনো কোন কিছু টাইপের প্রয়োজন হলে (তখন কম্পিউটার ছিল না) এবং অফিস সহকারী ছুটিতে থাকলে তাকে দেখা যেত নিজেই বসে গেছেন টাইপে। অথচ অধঃস্তন কাউকে দিয়ে চাইলে তিনি খুব সহজেই ‘ছোট’এ কাজটি আদায় করে নিতে পারতেন, অথবা বাইরে থেকে টাইপ করিয়ে আনতে পারতেন অফিসের টাকা খরচ করে।

যোগাযোগব্যবস্থা ততটা উন্নত না থাকাতে এবং একেবারে অনগ্রসর জেলার তকমা থাকার কারণে তখনকার দিনে পারতপক্ষে কেউ সুনামগঞ্জে চাকুরী করতে যেতেন না। অথচ ইফা’র সুনামগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে তিনি পড়ে থেকেছেন দিনের পর দিন। চাকুরী জীবনের স্বর্ণালি সময়ের সিংহভাগই (প্রায় ৩০ বছর) কাটিয়েছেন ওখানটায়। এ নিয়ে তার কোন অভিযোগও ছিল না। পাদ-প্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতেন বলে বরং একে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। হাওরের কাদা-মাটি- জল ভালবেসে হাওরাঞ্চলের মানুষদের আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। অতি কাছ থেকে অনুভব করতে পেরেছিলেন শিক্ষায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রয়োজনীয়তার কথা। তাইতো,অতি নিরবে দীর্ঘ সাধনার পর তিনি তাদের কথা ভেবে উদ্ভাবন করলেন “অংগুলীয় পদ্ধতিতে বর্ণমালা শিক্ষা,আনন্দ পাঠ” নামীয় এক অভাবনীয় পদ্ধতির,পরবর্তীতে যা ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত হয়ে হাওরাঞ্চলেরই বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রাক প্রাথমিক স্তরে পাঠদানের জন্য অনুমোদিত ও সমাদৃত হয় এবং ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়।

রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অতি নিরবে কাজ করে যাওয়া সেই কর্মবীরের গত পরশু ছিল শেষ কর্মদিবস অর্থাৎ চাকুরী থেকে অবসরে যাবার দিন। আমার বিশ্বাস, বিদায়ের এ দিনটিতে তার কোন দুঃখবোধ থাকার কথা নয়। কারণ, দেরিতে হলেও রাষ্ট্র তার মত গুণীজনের কদর করতে কসুর করেনি। মাত্র কিছুদিন হয় (গত নভেম্বরে) তিনি পরিচালক পদে পদোন্নতি পেয়ে সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যদি ও এ পদোন্নতি তিনি ১৫/২০ বছর আগে পাবারই কথা। ঢাকা য়্যুনিভার্সিটির দু’ দুটো ডিগ্রিধারী (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স এবং এল,এল,বি) হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন তিনি পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন শুধুমাত্র ওপর লেভেলে তেলবাজিতে পারদর্শী ছিলেন না বলে।

নিশ্চয়ই, এবার তিনি এ পদমর্যাদার ভার ও মর্যাদা নিয়ে সগৌরবে তার অবসর জীবন উপভোগ করবেন অন্য অনেক অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মতো, তবে সিলেট বিভাগের হাজার হাজার মউশিক শিক্ষক,ইমাম, মুয়াজ্জিন, মডেল পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান, জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয়ের অগণিত কর্মকর্তা,কর্মচারীগণের মতো তার অধীনে দুই যুগ আগে কাজ করা এ সহকর্মীটির মনের মণিকোঠায় তিনি থাকবেন আত্মার পরম এক আত্মীয় হয়ে, প্রাণপ্রিয় স্যার হিসেবে।

আজ এ বিদায়বেলা নেক হায়াত কামনার পাশাপাশি দোয়া করি শ্রদ্ধাভাজন স্যারের অবসর জীবন হোক পরম সুখদ, উপভোগ্য ও আনন্দময়
“সুফিয়ান চৌধুরীর ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *