দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট দ্বীপ-রাষ্ট্র নাউরু, অস্ট্রেলিয়া থেকে যেতে যেখানে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। সেই দ্বীপে প্রায় এক দশককাল ধরে বন্দি দুই বাংলাদেশি মুখ সেলাইয়ের মাধ্যমে প্রতিবাদ করছেন।

 
যারা অস্ট্রেলিয়ায় নৌকাযোগে অভিভাসন নিতে চায়, তাদের বন্দি করে নাউরুতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৩ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়া দ্বীপটিকে ব্যবহার করছে। বন্দি অনেককে পাপুয়া নিউগিনির মানুস দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বলে দেওয়া হয়, তাদের অস্ট্রেলিয়ায় কখনো স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হবে না।  

অস্ট্রেলিয়ায় কঠোর এই অভিবাসন নীতি দেশটির শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের ওপর চরম প্রভাব ফেলেছে। ১৫০ জনের বেশি শরণার্থী নাউরু ও পাপুয়া নিউগিনিতে রয়েছেন। তারা জানেন না, কখন তাদের পুনর্বাসন করা হবে, নাকি আদৌ করা হবে না।  
 
বাংলাদেশি দুই প্রতিবাদকারী মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ কাইয়ুম নাউরু দ্বীপে বন্দি রয়েছেন প্রায় দশ বছর ধরে। তারা এখন নাউরুর শরণার্থী পরিষেবা ও নিরাপত্তার জন্য তৈরি প্রশাসনিক কেন্দ্রের (আরপিসি১) বাইরে বিক্ষোভ করছেন। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আল-জাজিরার সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের।  

শফিকুল বলেন, আমরা অনশন শুরু করেছি। আমরা মুখ সেলাই করে নিয়েছি। খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কথা বলতে পারি না।  চিকিৎসা ও স্বাধীনতা না পাওয়া পর্যন্ত খাবার ও পানি ছুঁয়ে দেখব না।

শফিকুল ও কাইয়ুম ২০১৩ সালে আলাদাভাবে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যান। নিজ দেশে নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে তারা অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় চান। পরে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনী তাদের নৌকা থেকে আটক করে নাউরুতে পাঠিয়ে দেয়।  

শফিকুল বলেন, পরিস্থিতি নিরাপদ নয়। নাউরুতে শরণার্থীদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হয়। এখানকার চিকিৎসাব্যবস্থা খুব খারাপ। আমরা এখানে নিরাপদ নই। তারা শরণার্থী পছন্দ করে না। তারা আমাদের ঘৃণা করে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নাউরুকে ‘উন্মুক্ত কারাগার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, যেখানে বন্দিদের ওপর চলে নিপীড়ন-অবহেলা। তাদের চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শরণার্থী শিশুদের মধ্যে নিজের ক্ষতি, আত্মহত্যাসহ নানা প্রবণতা দেখা যায়। এ দেশে বন্দি ২০০ শিশুর মধ্যে মাত্র ৪ জনকে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।

শফিকুল ক্যানবেরা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে ২০১৬ সালে পুনর্বাসন ব্যবস্থার অধীন যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করেন। এই প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে তিন বছর পেরিয়ে গেছে।

শফিকুল বা কাইয়ুম কেউই জানেন না, তারা কবে মুক্তি পাবেন। কাইয়ুম অবশ্য পুনর্বাসন আবেদন প্রক্রিয়ার মধ্যে নেই। কিন্তু তারা দ্রুত এই দ্বীপ ছাড়তে চান এবং তাদের অনির্দিষ্টকালের আটকাদেশ থেকে মুক্তি পেতে চান।

শফিকুল লেখেন, আমাদের চিকিৎসা প্রয়োজন, স্বাধীনতা প্রয়োজন, আমরা বিচার চাই।  কোনো অপরাধ ছাড়াই ১০ বছর ঝুলে রয়েছি। আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে। আমরা আর নিতে পারছি না। দয়া করে আমাদের স্বাধীনতার জন্য সাহায্য করুন।

অস্ট্রেলিয়া সরকার সম্প্রতি নতুন একটি আইন করেছে, যাতে নাউরুতে বন্দি রাখার ক্ষমতা আরও শক্ত হয়েছে। এতে আশ্রয়প্রার্থীদের সে দেশে পাঠানোর আইনি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

সাবেক উদ্বাস্তু ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেহরুজ বুচানি অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির বিরুদ্ধে নাউরুতে শরণার্থী পাঠানোর বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। অস্ট্রেলিয়া সরকারের দাবি, মানবপাচার রোধে তারা দূরের একটি দ্বীপে শরণার্থীদের পাঠিয়ে দেয়। বেহরুজের দাবি, নিষ্ঠুরতাকে বৈধতা দিতে অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষ এসব কথা বলে থাকে।  

শফিকুল ও কাইয়ুমের বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তবে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। তার দাবি, দ্বীপে বন্দিদের মানসিক চিকিৎসাসহ সব ধরনের পরিষেবার সুবিধা রয়েছে। প্রয়োজনে চিকিৎসার স্বার্থে অস্ট্রেলিয়া বা তাইওয়ানে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চালু রয়েছে।

নাউরুকে- বন্দি রাখার স্থান হিসেবে ব্যবহার বাতিলের দাবিতে পার্লামেন্টে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিন পার্টি সিনেটে একটি বিল উত্থাপন করে। এতে বলা হয়, আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থীদের অস্ট্রেলিয়া সাময়িক আশ্রয় দেবে। এ ছাড়া তাদের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার সুযোগ করে দেবে। এরপর তাদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসিত করা হবে।

রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী ও শরণার্থী আইনজীবী ইয়ান রিন্তুল বলেন, এই বিল পাসের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, লেবার পার্টি এতে সমর্থন দেবে না বলেই মনে করি।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *