নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ খণ্ডাতে এবার সংবাদ সম্মেলনে আসছেন সিলেটের বিয়ানীবাজারের সৈয়দ নবীব আলী কলেজের অধ্যক্ষ মো. দিলওয়ার হোসেইন।
বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নস্থ কলেজের হলরুমে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এ লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন তাঁর অনুসারীরা।
অধ্যক্ষের সংবাদ সম্মেলন এবং তাঁকে ঘিরে স্থানীয় প্রভাবশালীদের তৎপরতায় কলেজের শিক্ষার্থীদের ‘উসকে’ দেওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। এনিয়ে আইনানুগ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
জানা যায়, গত ২৫ জুলাই আলীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহবাবুর রহমান খান শিশু সংবাদ সম্মেলন করে সৈয়দ নবীব আলী কলেজের অধ্যক্ষ মো. দিলওয়ার হোসেইনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ আনেন। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড সিলেট, জেলা প্রশাসন এবং উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন।
ইউপি চেয়ারম্যান তাঁর সংবাদ সম্মেলনে জানান, ১৯৯০ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে গভর্নিং বডির মাধ্যমে কলেজটি পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে দিলওয়ার হোসেইন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনি কলেজ প্রশাসনের একক আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁর কারণে এরপর থেকে কলেজের গভর্নিং বডি গঠিত হয়নি। তিনি বিভিন্নভাবে গভর্নিং বডি গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, কলেজের গভর্নিং বডি নিয়ে আদালতে রিট আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর গত ৯ জুলাই গভর্নিংবডি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর স্থানীয় সংসদ সদস্যের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে গভর্নিং বডির সভাপতি পদের জন্য তিনজনের নাম প্রস্তাব করার কথা থাকলেও কলেজ অধ্যক্ষ মো. দিলওয়ার হোসেইন স্থানীয় সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদকে না জানিয়ে সিলেট শিক্ষাবোর্ডে সভাপতি পদের সংক্ষিপ্ত নামের তালিকা জমা দিলে শিক্ষাবোর্ড বিধি অনুযায়ী এ তালিকা ফেরত পাঠিয়েছে। এরপর কলেজ অধ্যক্ষ নিজে কলেজে অনুপস্থিত রয়েছেন।
আহবাবুর রহমান খান শিশুর ওই সংবাদ সম্মেলনে চারখাই ইউপি চেয়ারম্যান হোসেন মুরাদ চৌধুরীসহ বিভিন্ন গ্রামের প্রতিনিধিত্বশীল শতাধিক লোক এবং অভিভাবকেরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, ইউপি চেয়ারম্যানের ওই সংবাদ সম্মেলনের পর পালটা সংবাদ সম্মেলন আহবান করেছেন কলেজটির অধ্যক্ষ মো. দিলওয়ার হোসেইন। ‘অধ্যক্ষকে জড়িয়ে মিথ্যা, বানোয়াট ও গোঁজামিলের বক্তব্য’ আখ্যা দিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে।
এনিয়ে বক্তব্য জানতে অধ্যক্ষ মো. দিলওয়ার হোসেইনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
জানা যায়, অধ্যক্ষ মো. দিলওয়ার হোসেইন গভর্নিং বডির নির্বাচনের পর থেকেই কলেজে অনুপস্থিত রয়েছেন। এরই মধ্যে গত রোববার কিছু সময়ের জন্যে তিনি কলেজে আসেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে বহিরাগতরা যুবকেরা আলীনগর রাস্তার মুখ থেকে স্লোগান দিতে দিতে কলেজ ক্যাম্পাসে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি কিছু সময় অতিবাহিত করেন, একটি বৈঠকেও অংশ নেন, যেখানে বহিরাগতরা ছাড়াও কলেজের গভর্নিং বডির নবনির্বাচিত দুইজন সদস্যও অংশ নেন।
সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে জানতে কলেজের শিক্ষক আবু আহমেদ সেলিম বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে কলেজ সম্পর্কে যেসব তথ্য দিয়েছেন সব সঠিক নয়। সত্য ঘটনা সকলকে জানানোর জন্যই মূলত কলেজ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের একজন শিক্ষক জানান, এলাকার কিছু প্রভাবশালীর প্ররোচনা ও সহায়তায় এবং বহিরাগতদের মাধ্যমে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এইধরনের সংবাদ সম্মেলন আমাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে না। এটা নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মহলে ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে দাবি করেন এই শিক্ষক।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বহিরাগতদের সহায়তায় এটা নিয়ে উসকে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে এর ফল ভয়াবহ হয়ে ওঠতে পারে।
সৈয়দ নবীব আলী কলেজের অধ্যক্ষ দিলওয়ার হোসেইনের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম জায়গীরদার বলেন, সভাপতি মনোনয়ন নিয়েই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অধ্যক্ষ আমিসহ তিনজনের নাম বোর্ডে পাঠান। বোর্ড থেকে অনুমোদন না হয়ে তালিকা ফেরত আসে। স্থানীয় চেয়ারম্যানও সভাপতি হতে চেয়েছিলেন। এরমধ্যে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে কলেজের বিষয়ে নানা অভিযোগ তোলেন। এই বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদ জানাতে সংবাদ সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছে।
পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন এলাকায় উত্তেজনা ও বিভাজন সৃষ্টি করছে কিনা, এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান মনির বলেন, কলেজে কোনো কমিটি ছিল না। সম্প্রতি সভাপতি পদ ছাড়া অন্য পদে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয়। পরে অধ্যক্ষ সভাপতি মনোনয়নের জন্য আমিসহ ৩ জনের নাম বোর্ডে পাঠানের উদ্যোগ নেন। এটা অনুমোদনের জন্য এমপির ডিও লাগে। এমপি মহোদয়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারি, তিনি অধ্যক্ষকে আমাদের ইউপি চেয়ারম্যান আহবাবুর রহমান খান শিশুর নামটিও তালিকায় দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু এই নাম না দেওয়ায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। বোর্ডেও অনুমোদন না হয়ে ফেরত আসে।
পরে আমরা স্থানীয়ভাবে বসে আমি ও মহানগর যুবলীগের সভাপতি মুশফিক জায়গীরদার ছাড় দিই। কিন্তু ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম জায়গীরদার ও চেয়ারম্যান আহবাবুর রহমান খান শিশুর মধ্যে সমঝোতা হয়নি। তাই জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আসলেই এলাকায় বিভাজন হচ্ছে।
মনিরুজ্জামান মনির বলেন, এলাকার স্বার্থে এবং কলেজের শিক্ষার পরিবেশের স্বার্থে আমাদের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। আমি এই তালিকা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করছি। আশা করি কলেজ অধ্যক্ষ সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদের মতামতকে গুরুত্ব দেবেন।
উত্তেজনাকর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফসানা তাসলিম বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি।
বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এই রকম কোনো তথ্য এখনো আমরা পাইনি। খোঁজ নিয়ে দেখছি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, সিলেটের সচিব অধ্যাপক মো. কবির আহমদ বলেন, কলেজ থেকে সভাপতি পদে তিন জনের নাম বোর্ডে পাঠানো হয়। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্যের মতামতের বাইরে পাঠানোয় এটা ফেরত পাঠানো হয়েছে। সংসদ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে নতুন তালিকা পাঠানোর জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু অধ্যক্ষ এখনো পাঠাননি।
সূত্রঃ সিলেট টুডে