সিলেট নগরীর আখালিয়া বড়বাড়ি এলাকার সোনিয়া আক্তার। তার স্বামী জাকির হোসেন কুয়েত প্রবাসী। সাত বছর বয়সী কন্যা সন্তান ও পরিবারে কয়েকজন সদস্য নিয়ে তিনি এই এলাকায় বসবাস করেন। চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনের ফলে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছয়দিন ধরে সোনিয়া তার স্বামীর সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। তাই অনেক উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিনযাপন করছেন তিনি। 

সোনিয়া আক্তার বলেন,  ছয়দিন হলো আমার স্বামীর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। এত বছর ধরে ইমু, হোয়াসঅ্যাপে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু এখন মোবাইলে ইন্টারনেট নাই। তাই কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। আমার স্বামী গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকবার মোবাইলের সিমের নাম্বারে আইসডি কল দিয়েছেন। কিন্তু কল রিসিভ করলেও কিচ্ছু শোনা যায় না। আমার মেয়টা তার বাবার সাথে প্রতিদিন কথা বলতো। এখন কথা বলতে না পাড়ার অনেক কান্নাকাটি করে। সরকারের এভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। 

সিলেট নগরীর ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকার ব্যবসায়ী কামাল আহমদের এক ভাই কাতার ও আরেক ভাই ফ্রান্স প্রবাসী। বিগত কয়েকদিন যাবত তাদের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে তিনিও অনেক দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। 

কামাল আহমদ  বলেন, আন্দোলন সামলাতে না পেরে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের ভুলের খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে। আমার ভাই জালাল আহমদ কাতার প্রবাসী। আরেক ভাই আরিফ আহমদ ফ্রান্স প্রবাসী। তাদের সাথে সবসময় ইন্টারনেটে যোগাযোগ করেছি। এখন বিগত ছয়দিন যাবত কোনো যোগাযোগ নাই। তারাওতো শুনেছে দেশে আন্দোলন চলছে। এরপরই সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা যে ভাল ভাল আছি এই খবরটিও তাদের দিতে পারছি না। চলমান পরিস্থিতিতে আমরা যত দুশ্চিন্তায় আছি তার চেয়েও বেশি দুশ্চিন্তায় তারা আছে। 

কোটা সংস্কারের দাবীতে গত ১৫ জুলাই থেকে সারা দেশে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার পর এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়।  সারাদেশে দেড়শতাধিক নিহত হয়। এই নিহতের তালিকায় সাংবাদিক, পথচারী, পুলিশ, সাধারণ মানুষও রয়েছেন। 

এই আন্দোলন সহিংস রূপ নিলে  প্রথমে মোবাইল সিমের কোম্পানিরা নেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ১৮ জুলাই রাতে ওয়াইফাই সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার ফলে সারা বিশ্বের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ।বর্তমানে প্রবাস থেকে কোনো আইসডি কল আসলেও কোনো কথা শুনা যায় না। এমনকি দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশে আইএসডি কল করলেও কোনো কথা শুনা যায় না।

মঙ্গলবার রাত থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারন্টে চালু হলেও বন্ধ রয়েছে ফেসবুক, হোয়াটঅ্যাপসহ সব সামাজিক যগোযোগমাধ্যম। ফলে প্রবাসীরা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৬৩টি দেশে প্রায় ১ কোটির উপরে প্রবাসী রয়েছেন। এরমধ্যে সিলেট বিভাগের চার জেলার প্রায় প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নের ২ লাখের উপরে মানুষ ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। 

এই লাখ লাখ প্রবাসী প্রতিদিনই তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু, মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। এইসব যোগাযোগের মাধ্যমের চালিকাশক্তি হল ইন্টারনেট। কেউ মোবাইল ডাটা দিয়ে কেউবা ওয়াইফাই সংযোগের মাধ্যমে এসব অ্যাপ ব্যবহার করেন। কিন্তু চলমান এই অস্থির পরিস্থিতিতে দেশে সবধরনের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় সোনিয়া আক্তার ও কামাল আহমদের মত সিলেটের লাখ লাখ প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যরা দুশ্চিন্তায় দিনযাপন করছেন। 

সিলেট নগরীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা জহুরা চৌধুরী। তার স্বামী রহিম উদ্দিন আমেরিকা প্রবাসী। জহুরা চৌধুরী বলেন, ইন্টারনেট না থাকার কারণে আমার স্বামীর সাথে গত ছয়দিন ধরে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। মোবাইল ফোনে সরাসরি কল দিলে কল রিসিভ হয় টাকা কাটে কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে কোনো শব্দ আসে না। এদিকে আমি একজন শিক্ষার্থী। যেহেতু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাই আমার স্বামী অবশ্যই আমাকে নিয়ে আরও বেশি দুশ্চিন্তায় আছেন। 

শেখঘাট কলাপাড়া এলাকার বিলকিস আক্তার। তার ছেলে ফরহাদ আহমেদ লন্ডন প্রবাসী। বিলকিস আক্তার বলেন, আমার ছেলে প্রতিদিন দুইবার ভিডিও কল দিত। আজ পাঁচ ছয়দিন হল আমার ছেলের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। তাই খুব দুশ্চিন্তায় আছি। ছেলেটা কেমন আছে বা আমরা কেমন আছি কিছুই জানাতে পারছি না। তাই অনেক চিন্তায় আছি । এখন শুধু ইন্টারনেট আসার অপেক্ষা করছি। 

সিলেট নগরীর জালালাবাদ এলাকার রুবিনা আক্তারের স্বামী ফ্রান্স প্রবাসী, বোন আমেরিকা প্রবাসী, ভাই ইতালি প্রবাসী। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে তিনিও কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। রুবিনা বলেন, আমার স্বামী, ভাই বোন কারো সাথে কোনা যোগাযোগ করতে পারছি না ওয়াইফাই সংযোগ বন্দ করার কারণে। বাসার টিভিও ইন্টারনেট চালিত। তাই কখন ইন্টারনেট আসবে এই খবর জানার জন্য প্রতিদিন পাশের বাসায় গিয়ে টিভির সামনে বসে থাকি। আমাদের স্বজনদের জন্য আমরা যত দুশ্চিন্তা করছি তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করছেন আমার প্রবাসী আত্মীয় স্বজনরা। 

এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক ও  অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বাংলাদেশের যে অঞ্চল থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশ যান তার মধ্যে অন্যতম সিলেট বিভাগ। সিলেট বিভাগের চার জেলার দুই লাখেরও বেশি মানুষ প্রবাসে আছেন। এ অঞ্চলের প্রচুর লোকজন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ নানা দেশে বসবাস করছেন। বহু বছর ধরে এই প্রবাসীরা মোবাইল ইন্টারনেটে হোয়াসঅ্যাপ, ইমুর মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু এই সময়টাতে যারা দেশের বাইরে আছেন তারা দেশের খবর পাচ্ছেন না তাই দুশ্চিন্তায় আছেন। প্রবাসীরা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এতে প্রবাসীরা ও দেশে থাকা তাদের স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকার কারণে বিদেশ যাওয়া আসা রেমিটেন্সসহ সবকিছুর উপরই খারাপ প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে শরিফুল হাসান বলেন, প্রবাসীদের সাথে যোগযোগতো শুধু পারিবারিক কারণে না, রেমিটেন্সের কারণেও তাদের সাথে যোগাযোগ দরকার। প্রবাসীদের সাথে যদি চার পাঁচ দিন যোগাযোগ না থাকে, ইন্টারনেট না থাকে তাহলে কিন্তু বিদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠানোর উপরও বেশ প্রভাব পড়বে। তাই আমরা কাছে মনে হয় প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের সবচেয়ে বড় প্রভাব সিলেট বিভাগের উপর পড়বে। আশা করি সরকার খুব দ্রুতই ইন্টারনেট চালু করবে। প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগ স্বাভাবিক হবে। তাছাড়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলে ফ্লাইটে একজন যাত্রী কখন যাবে কখন আসবে এগুলো নিয়ে বিদেশগামীরা এবং বিদেশ থেকে আগতরা বেশ ভোগান্তিতে পড়ছেন। আশাকরি সরকার এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবে।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.