বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে আবারও নারী কেবিন ক্রু পাইলটের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১২ নভেম্বর বিমাবের জেদ্দা-সিলেট-ঢাকা (বিজি-২৩৬) ফ্লাইটে এ ঘটনা ঘটে। এর দুদিন আগে (১০ নভেম্বর) ঢাকা-চট্টগ্রাম-জেদ্দা (বিজি-১৩৫) ফ্লাইটে ঘটে আরেকটি এমন ঘটনা। খবর ‘মানবজমিন’র।


এই দুই ঘটনার পর ভুক্তভোগী কেবিন ক্রু’রা বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাফিকুর রহমান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের পরপরই বিমানের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী দু’পক্ষের শুনানি করছে।

তদন্ত কমিটি বলছে- যদি অভিযোগের সত্যতা মিলে তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৪ নভেম্বর বিমানের সিইও বরাবর এক পাইলটের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি এবং অপেশাদারমূলক আচরণের অভিযোগ করেন ফ্লাইট সার্ভিস উপ-বিভাগের এক কেবিন ক্রু।

ওই অভিযোগে বলা হয়, গত ১০ নভেম্বর বিজি-১৩৫ নম্বর ফ্লাইট (ঢাকা-চট্টগ্রাম-জেদ্দা) অপারেট করেন অভিযোগকারী এক নারী কেবিন ক্রু। এই ফ্লাইটে অপারেটিং পাইলট ছিলেন মুনতাসীর ও আবেদ। ফ্লাইটের মাঝামাঝি সময় তারা ওই নারী কেবিন ক্রুকে ককপিটে ডাকেন। কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে পাইলট আবেদ তার সঙ্গে অপেশাদারমূলক (ব্যক্তিগত) কথাবার্তা বলেন। পরবর্তীতে ককপিট দরজার সামনে তাকে একা পেয়ে জোরপূর্বক হ্যান্ডশেক করতে চান পাইলট আবেদ।

পরে ১২ নভেম্বর ফিরতি ফ্লাইটে (বিজি-২৩৬ জেদ্দা-সিলেট-ঢাকা) এই কেবিন ক্রুর ‘ওয়ার্কিং পজিশন’ ছিল সামনে। কাজের জন্য তাকে বেশ কয়েকবার ককপিটে যেতে হয়েছে। তখন পাইলট আবেদ কৌতুক শোনানোর ছলে তাকে বাংলা ব্যাকরণের লিঙ্গ নিয়ে কথা বলতে চান। একপর্যায়ে কুরুচিপূর্ণ এবং অশ্লীল কথা বলতে শুরু করেন। এ ছাড়া নারী কেবিন ক্রুর দিকে নোংরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেন। ওই দিন রাতেই বিমানের এমডি ও সিইও বরাবর ইমেইলে পাইলট আবেদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী নারী।

সূত্র আরও জানায়, গত ৩ নভেম্বর ঢাকা থেকে মাসকটগামী বিজি ৭২১ নম্বর ফ্লাইট ছেড়ে যায়। এই ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন ইউসুফ মাহমুদ। তিনিও এক নারী কেবিন ক্রুকে ককপিটে ডেকে যৌন হয়রানি করেন। এ ঘটনায় গত ৭ নভেম্বর বিমানের এমডি ও সিইও বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন ওই নারী কেবিন ক্রু।


লিখিত অভিযোগে ওই নারী জানান, মাসকটগামী ফ্লাইটে পাইলট ইউসুফ ওই নারী কর্মীকে ককপিটে ডেকে নিয়ে তার শরীর স্পর্শ করেন এবং জোর করে কমলা খাইয়ে দেন।

এর আগে ২০১৯ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১০ জন পাইলটের বিরুদ্ধে ককপিটে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন একাধিক নারী কেবিন ক্রু। বিমানের জ্যেষ্ঠ পাইলট ইশরাত আহমেদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে তখন এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। তবে এসব ঘটনায় দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি বিমান। অথচ বিমানের ককপিটে পাইলটের সব সময় ফ্লাইট পরিচালনায় সতর্ক থাকতে হয়। অথচ সেখানে ওই ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা দুঃখজনক বলে মনে করেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। আকাশপথে এই ধরনের কর্মকাণ্ড খুবই বিপজ্জনক।

এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে এর আগেও অনেক নারী কেবিন ক্রু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। বেশির ভাগ ঘটনায় বিমানের পাইলটদের সম্পৃক্ততা মিলেছে। ককপিটের মতো সুরক্ষিত জায়গায় নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানির ঘটনা বিমানের ভাবমূর্তি রক্ষায় ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বিষয়গুলো জানাজানির পর অন্য নারী কেবিন ক্রু’রাও চিন্তিত। এ ছাড়া যৌন হয়রানির পরও অনেক কেবিন ক্রু মুখ খুলেন না। কারণ মুখ খুললে তাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। পাইলটদের আধিপত্য চাকরি হারানোর শঙ্কায় থাকেন তারা। তাই অনেকে নীরবে এসব হয়রানি মেনে নেন। প্রতিবাদ করার সাহসও পান না।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, আমি মনে করি এটার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ এরকম পরিবেশ হলে মেয়েরা কীভাবে কাজ করবে? সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ছেলে-মেয়ে সবারই কাজ করার অধিকার আছে। অভিযোগ সত্য হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এ ছাড়া এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে, কীভাবে ঘটছে এবং এটি কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা দেখতে হবে। প্রয়োজনে ক্যামেরা বসিয়ে দিতে হবে।

বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) ও মাসকটগামী ফ্লাইটের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান বোসরা ইসলাম বলেন, যৌন হয়নারির ওই অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। শুনানি পর্যায়ে আছে। দু’পক্ষের শুনানি করা হচ্ছে। আমরা বিষয়টিকে খুবই সিরিয়াসলি দেখছি। আশা করি- খুব দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.