ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বা অন্য উপায়ে ইউরোপে প্রবেশ করা অবৈধ বাংলাদেশিদের নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) অনেক দেশ। বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিভিন্ন সময়ে ওই উদ্বেগ জানানো হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এখনো প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি রয়েছেন। এর মধ্যে ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়া যুক্তরাজ্যেই রয়েছেন ৮ লাখ বাংলাদেশি। ইউরোপে যাওয়া এসব বাংলাদেশির একটি বড় অংশ নানা উপায়ে সেখানে গিয়ে অবৈধ হয়ে পড়েছেন। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ২০১৭ সালের যে চুক্তি রয়েছে, সে অনুযায়ী ফেরত পাঠাতে অব্যাহত চাপ দিচ্ছে দেশগুলো।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ইউরোপের যে সব দেশে অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা বেশি, সেসব দেশের পক্ষ থেকে বারবার এ নিয়ে উদ্বেগ জানানো হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছে। চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপের দেশগুলো থেকে যে তালিকা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে যারা বাংলাদেশি হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছেন তাদের ফেরত আনা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ইউরোপ থেকে প্রায় ৭০০ জনকে ফেরত আনা হয়েছে। তালিকায় আরও অবৈধ প্রবাসীর নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে কাজ চলছে। বাংলাদেশি হিসেবে নিশ্চিত হলে সবাইকে ফেরত আনবে সরকার।
অভিবাসন বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশি কর্মীদের ইউরোপে যাওয়ার সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এটা খুবই কম। সারা বিশ্বে এখন দক্ষ শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা। এ চাহিদা মেটাতে ইউরোপের দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন খাতে দক্ষ লোকবল নিচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশের লোকজন প্রতিযোগিতা করে ইউরোপ যাচ্ছেন। সেখানে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতা রয়েছে। ফলে বৈধ পথে সুযোগ না পেয়ে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা। গত বছর বিদেশে যান ১০ লাখ ১২ হাজার বাংলাদেশি। অথচ ২৮টি দেশের জোট ইউরোপে গেছে মাত্র ১৬ হাজার ৭৭ জন।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইউরোপের যে সব দেশ অবৈধ বাংলাদেশিদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য চাপ দিচ্ছে, এর মধ্যে রয়েছে- ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, মাল্টা, গ্রিস, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি। ইউরোপের সব দেশেই বাংলাদেশিরা কর্মরত আছেন, কিন্তু ওই দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন। সূত্র জানায়, বৈধ ও অবৈধ মিলে শুধু ইতালিতে আছেন আড়াই লাখ, ফ্রান্সে আছেন এক লাখ, স্পেনে ৬০ হাজার, গ্রিসে ৪০ হাজার, জার্মানিতে ২৫ হাজার এবং ইউরোপের অন্যান্য প্রতিটি দেশে আছেন ২৫ হাজারের কম। যুক্তরাজ্যে ৮ লাখ বাংলাদেশির মধ্যে যারা অবৈধ আছেন, তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বারবার বাংলাদেশকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। বিশেষ করে, এসব দেশ থেকে যখন কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের কেউ সফরে আসেন তখন তারা এ ব্যাপারে চাপ দেন। এ ছাড়া ঢাকায় ওই সব দেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কথা তোলা হয়।
সম্প্রতি ইতালির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মারিয়া ত্রিপদি ঢাকা সফরকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাগাদা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও ফেরত আনার আশ্বাস দেওয়া হয়। ইতালির প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশ অবৈধদের ফিরিয়ে নিলে বৈধদের ভিসা দেওয়ার হার বাড়ানো হবে। যারা ইতালিতে যাবেন তারা যেন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষে ফিরে আসেন, এই শর্ত মানতে হবে। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও অনেকেই দেশে ফিরে আসেন না। এ জন্য ইতালি সরকারের পক্ষ থেকে নানা সময় উদ্বেগ জানানো হয়। এ ছাড়া বর্তমানে পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে ৯টি দেশ থাকলেও গ্রিস ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে সমঝোতা স্মারক নেই। দক্ষিণ ইউরোপের মধ্যে ইতালির সঙ্গে চলতি বছর নতুন সমঝোতা স্মারক হওয়ার কথা রয়েছে। অস্ট্রিয়া, স্পেন ও পর্তুগালের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা বারবার অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়াকে নিরুৎসাহিত করছি। কিন্তু কিছু দালালের প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশিরা অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে বিদেশ যাচ্ছেন। এভাবে যেতে গিয়ে অনেকেই ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা যাচ্ছেন বা যাওয়ার পর কারাবন্দি হচ্ছেন। এতে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমরা চাই, অবৈধ উপায় বন্ধ করে, বৈধপথে বিদেশ পাঠাতে।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.