হজ-পরবর্তী জীবনে হাজিদের করণীয় সম্পর্কে কথা বলেছেন দেশবরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও কোরআন গবেষক মাওলানা শায়খ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন। তিনি জামালী তালিমুল কোরআন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং ২৪ ঘণ্টায় কোরআন শিক্ষা মেথডের আবিষ্কারক। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন নূর আহমাদ
হাজিরা দেশে ফেরার অপেক্ষা করছেন। হজ-পরবর্তী জীবনে হজের ঘ্রাণ ধরে রাখার বিষয়ে আপনার নসিহত কী?
হজের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করা।আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নির্দিষ্ট মাসে হজ অনুষ্ঠিত হয়। এই মাসে যার ওপর হজ ফরজ হয়, সে যেন হজে গিয়ে স্ত্রী সম্ভোগ, অনাচার ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়।তোমরা যেসব সৎ কাজ করো, আল্লাহ তা জানেন। আর পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করো, নিশ্চয়ই তাকওয়া বা আল্লাহভীতিই শ্রেষ্ঠ পাথেয়।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৯৭)
হাজিরা হজের শিরকমুক্ত নির্ভেজাল তাওহিদের ঘোষণা দেন বারবার। তাই বাকি জীবন শিরক থেকে দূরে থাকা সবচেয়ে জরুরি বিষয়। ব্যক্তিজীবনে আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম না মানার পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সব ধরনের অনাচার ও তাগুতকে অস্বীকার করার মাধ্যমে মর্দে মুমিন হওয়ার প্রশিক্ষণই হজ। যাদের হজ কবুল হয়, তাদের জীবনের মোড় ঘুরে যায়।গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার আগ্রহ বাড়ে। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি মানুষ যত্নবান হয়।
হজ করার পর যার জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি, তার হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। পীর-মাশায়েখরা বলেন, ‘নেক কাজ কবুল হওয়ার আলামত হলো, পরবর্তী সময়ে জীবনে নেক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। আর অভিশপ্ত পাপী জীবনের আলামত হলো, অব্যাহতভাবে পাপ কাজ করে যাওয়া।
হজ কবুল হওয়ার আলামত হলো, ইহরামের সুবাস কখনো জীবন থেকে হারিয়ে যাবে না। দুনিয়ার লোভ-লালসা, অশ্লীলতা, মোহ তাকে প্রভাবিত করবে না। নিখাদ সোনার মানুষ হয়ে সে দুনিয়ায় জীবন যাপন করবে। তার কাজে কেউ কষ্ট পাবে না। সে কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে লুট করবে না। চাঁদাবাজি, রাহাজানি, নারীর শ্লীতহানির কথা তাকে দিয়ে কল্পনাও করা যাবে না। অন্যদিকে সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাবন্দি হবে। হবে কোরআনের কর্মী। কোরআন বাস্তবায়নের মহৎ লক্ষ্যই হবে তাও জীবনের ভিশন ও মিশন।
হজ থেকে ফেরার পর একজন হাজিকে কী কী আমল করতে হয়?
হজ থেকে ফিরে এসে নিকটস্থ মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। কাব বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে নফল নামাজ আদায় করতেন।’ (বুখারি শরিফ)
হজ থেকে ফিরে শুকরিয়াস্বরূপ গরিব-মিসকিন ও আত্মীয়-স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া বৈধ। ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় একে ‘নকিয়াহ’ বলা হয়। জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবিরা তা থেকে আহার করেছেন।’ (বুখারি শরিফ)
তবে অহংকার, লোক-দেখানো, রাজনৈতিক প্রচারণা কিংবা বিশেষ উদ্দেশ্যে এমন দাওয়াতের ব্যবস্থা করা শরিয়ত অনুমোদন করে না। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া, ৭ম খণ্ড, ১৮৫ পৃষ্ঠা)
হজ করে দেশে ফেরার পর ঘরে পৌঁছে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন দুই রাকাত নামাজ পড়বে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে, তখনো দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করবে।’ (মুসনাদে বাজ্জার)
হাজিদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানোর বিষয়ে ইসলাম কী বলে?
যাঁরা হজ করে আসছেন, তাঁদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো, তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুসাফাহ ও কোলাকুলি করা এবং তাঁদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব। কিন্তু রাজনৈতিক প্রচারণার উদ্দেশ্যে হাজিকে ফুলের মালা দেওয়া, তাঁর জন্য শরিয়তবিরোধী স্লোগান দেওয়া, যানজট সৃষ্টি করে মিছিল করা শরিয়তের অপছন্দনীয়। এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। (আপকে মাসায়েল আওর উনকি হল, ১ম খণ্ড, ১৬২ পৃষ্ঠা)
হজ পালন শেষে হাজিরা জমজমের পানি নিয়ে আসেন। এই জমজমের পানি নিয়ে এসে লোকজনকে পান করানো মুস্তাহাব। (মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ, ৩০৩ পৃষ্ঠা)
আম্মাজান আয়েশা (রা.) হজ থেকে ফেরার সময় জমজমের পানি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘রাসুল (সা.) জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে যেতেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১১৫)
✍🏻নূর আহমাদ
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.