বিশ্বে এমন কিছু শহর আছে, যেসব শহরে ঢুকলে মনে আলস্য ভর করবে, প্রজাপতির ডানা মেলে পুরো শহর উড়ে উড়ে দেখার সাধ জাগবে। গল যেমন। প্রেসবক্সের সামনে লং অনে ফিল্ডিং করছেন মুশফিকুর রহিম। টেস্টে এখানে বল কালেভদ্রে আসে।তিনি ডানে তাকালেই গল ফোর্টের পাড়ে আরব সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউ দেখা যায়। এ মাঠে এক শ’র ওপর গড়ে রান করা মুশফিকের কাছে এ দৃশ্য অচেনা নয়। তবু বল আর ওভারের ফাঁকে তাঁর দৃষ্টি সেই সেসব ঢেউ এড়ায়নি সম্ভবত। এমন দৃশ্য শরীর আর মনের ক্লান্তি দূর করে দেওয়ার কথা।

ক্রিকেট খেলার দৈর্ঘ্য, সেটা টেস্ট হলে তো কথাই নেই। ওভারের পর ওভার, সেশন ধরে ধরে পাঁচদিন শরীরের চেয়ে মনের সঙ্গে লড়াইটাই বেশি। খোলামেলা মাঠ, সমূদ্রের ঢেউ-গর্জন আর সামনে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত গল ফোট- দুর্দান্ত এক ক্রিকেটীয় ছবি। সাদা কিংবা রঙিন, যে রঙের ক্রিকেটই হোক না কেন- গল স্টেডিয়াম উজার করে দেয় এর খেলোয়াড় থেকে শুরু করে দর্শকদের।হাঁড়ভাঙ্গা মাঠের লড়াই আছে, সঙ্গে আছে সেই লড়াইয়ে ফুরিয়ে যাওয়া জ্বালানিতে ফের প্রাণশক্তি ফিরে পাওয়ার উপযোগী পরিবেশ। গল আপনাকে ক্লান্ত করবে না, অবসাদগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ তো নেই-ই। 

অবসাদগ্রস্ত নয় গল টেস্টও। অথচ বৃষ্টিবিঘ্নিত তৃতীয় দিন শেষে মনে হচ্ছিল নিশ্চিত ড্রয়ের দিকে এগুচ্ছে ম্যাচটি। বাংলাদেশের অফস্পিনার নাঈম হাসানের ক্যারিয়ারে চতুর্থবার ৫ উইকেট প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস (৪৮৫ রান) শেষ হয় চতুর্থ দিনের মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতির ঠিক পরপর।

সে সময়ও তো মনে হচ্ছিল ম্যাচের ভাগ্য থেকে একটি সম্ভাব্যতা মুছে গেছে- শ্রীলঙ্কার হারার সম্ভাবনা নেই। তখনো ড্রয়ের পাল্লা ভারি। বরং টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ দলের বিভীষিকাময় অতীত স্মরণে মনে হচ্ছিল স্বাগতিকরা না আবার জিতে যায়! কিন্তু চা-বিরতির পর ম্যাচে নতুন টুইস্ট- সাদমান ইসলাম আর নাজমুল হোসেনের উর্ধ্বগতির জুটি সম্ভাবনার নতুন সরণিতে নিয়ে গেছে ম্যাচকে। চতুর্থ দিনের শুরু থেকে গলে বল ঘুরছে, পেসারদের বেলায়ও মাঝেমধ্যে নীচু হচ্ছে। তাতে পঞ্চম দিনে দু শ রানের অগ্রগামীতার পর যদি লঙ্কানদের ওপর স্পিনারদের লেলিয়ে দেন নাজমুল, জিতেও যেতে পারে বাংলাদেশ। চতুর্থ দিনশেষে এরইমধ্যে ১৮৭  রানে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আজ এক সেশনে সেই ব্যবধান আরও বাড়িয়ে শেষ দুই সেশনে জয়ের জন্য বাজি ধরবেন নাকি নাজমুল হোসেন? বাংলাদেশ দলের শরীরী ভাষা কিন্তু এর পক্ষেই বলছে। 

নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে পঞ্চম দিনে গড়ানো গল টেস্টে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি দীর্ঘশ্বাস যুক্ত হয়েছে, সেটি সাদমানের শতক হাতছাড়া হওয়ার। দ্বিতীয় ইনিংসে চিরায়ত নড়বড়ে বাংলাদেশের প্রতি আক্রমণ তো শুরু করেছিলেন এই ওপেনারই। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে মিলান রত্নায়েকের নীচু হয়ে আসা বলে সাদমান এলবিডাব্লিউ হয়েছেন ৭৬ রান করে।

চতুর্থ দিনের শেষে নাজমুলের সঙ্গী মুশফিকুর রহিম। আর ড্রেসিংরুমে পঞ্চম দিনে রানের গতি বাড়ানোর অপেক্ষায় লিটন দাস, জাকের আলীরা। সবশেষে যদি ‘রণক্লান্ত’উইকেটের ফায়দা নিতে পারেন নাঈম ও তাইজুল ইসলাম… নীরবে টেস্ট ক্রিকেটের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে চলেছে নান্দনিক গল।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.