৩৫ জুলাই অর্থ্যাৎ ৪ঠা আগস্ট ২০২৪। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে উত্তপ্ত ছিল সিলেট শহর। বিশেষ করে এদিন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা। গোলাপগঞ্জের ইতিহাসে ঐ দিন নেমে আসে এক কালো অধ্যায়। উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ও গোলাপগঞ্জ চৌমুহনীতে চলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ।

ঘটনার সূত্রপাত সকাল ১০টায় শুরু হলেও দিনব্যাপী আন্দোলনে একে একে গুলিতে প্রাণ হারান ৬বীর সন্তান। দিনের শুরুটা ঝলমলে রৌদ্রউজ্জ্বল থাকলেও শেষ হয় বিষাদে। গোলাপগঞ্জবাসীর কাঁদে উঠে ছয়টি লাশ, আহত হয় অসংখ্য মানুষ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উপজেলা পর্যায়ে এক সঙ্গে এতো প্রাণহানির নজির সিলেট তথা সারাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। এতো মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে তারা রচনা করেছেন এক অনন্য ইতিহাস। 

আজ (৪ আগস্ট ) সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের এক বছর পূর্ণ হলো। সেই দিন হাসিনা সরকার পতনের লক্ষ্যে এক দফার অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে গোলাপগঞ্জে পুলিশ-বিজিবি এবং সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তারা। নিহতরা হলেন, উপজেলার নিশ্চিন্ত গ্রামের মৃত তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম (২৪), দক্ষিণ রায়গড় গ্রামের মৃত ছুরাই মিয়ার ছেলে জয় আহমদ (১৮), শিলঘাট গ্রামের কয়ছর আহমদের ছেলে সানি আহমদ (২২), বারকোট গ্রামের মৃত মকবুল আলীর ছেলে তাজ উদ্দিন (৩৯), দত্তরাইল বাসাবাড়ি এলাকার আলা উদ্দিনের ছেলে মিনহাজ আহমদ (২৩) ও উত্তর ঘোষগাঁও গ্রামের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন (৩৫)।

এদিকে ঘটনার বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বেঁচে আছে ৬টি শহিদ পরিবার। বছর পার হলেও পরিবারগুলো পায়নি তাদের প্রিয়জন হারানোর বিচার। তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি চায় গোটা গোলাপগঞ্জবাসী। স্বীকৃতি হিসেবে, তাদের স্মরণে গোলাপগঞ্জ বাজার চৌমুহনীতে চত্বরের দাবি তুলেছেন উপজেলাবাসী।

কি ঘটেছিল সেদিন?

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, ঘড়িতে তখন সকাল প্রায় ১০টা। ঢাকাদক্ষিণ সরকারি কলেজ থেকে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি ঢাকাদক্ষিণ লঞ্চঘর হয়ে বাজার প্রদক্ষিণ করে ইউনিয়ন রোড হয়ে চৌমুহনীতে যাচ্ছিল। এর আগে ঢাকাদক্ষিণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান ফটকের সামনে তৎকালীন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত চৌধুরী ও গোলাপগঞ্জ মডেল থানার তৎকালীন ওসি মাছুদুল আমিনের নেতৃত্বে অবস্থান নেয় পুলিশ ও বিজিবি। কলেজের সামনে আসা মাত্র শান্তিপূর্ণ মিছিলে বিপত্তি ঘটায় পুলিশ। বাঁধা অতিক্রম করে নানা স্লোগান দিয়ে এগুতে থাকে মিছিলটি। একপর্যায়ে দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ-বিজিবিকে ধাওয়া করে বিক্ষুব্ধরা। এসময় বিজিবির গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ধাওয়া খেয়ে পেছন হটে তারা। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যেই পাল্টে যায় ঘটনার মোড়। ছাত্র-জনতা মিছিল সহকারে গোলাপগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে, ঢাকাদক্ষিণ ব্র্যাক অফিসের পাশে থেকে ছাত্রদের লক্ষ করে গুলি, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় পাশ্ববর্তী মসজিদে মাইকিং করা হলে ব্যবসায় প্রতিষ্টান বন্ধ করে, বাড়িঘর ছেড়ে আন্দোলনে যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ। মুহুর্তেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় ঢাকাদক্ষিণ বাজার। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি, টিয়ার শেল এবং সাউ- গ্রেনেড ছুড়তে থাকলে অসংখ্যা মানুষ আহত হন। গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যায় অনেকের শরীর। অঝরে বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরতে দেখা যায় অনেকের শরীর থেকে। তখন ঢাকাদক্ষিণবাসী স্বাক্ষী হয় হৃদয় বিদারক মূহুর্তের। তবে এখানেই থেমে থাকে নি তারা। চারিদিক থেকে আন্দোলনে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ। এতে আন্দোলনের বেগ তীব্র থেকে ভবাবহ আকার ধারণ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধাওয়া করে গোলাপগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন আন্দোলনকারী। দুপুর প্রায় ১২টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে অবস্থান নেয় পুলিশ ও বিজিবি। সেখানে যাওয়া মাত্র আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি, টিয়ার শেল এবং সাউ- গ্রেনেড ছুড়তে থাকে তারা। এসময় তাজ উদ্দিন, নাজমুল ইসলাম, জয় আহমদ ও সানি আহমদ গুলিবিদ্ধ হন। তাজ উদ্দিন ও নাজমুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। জয় ও সানি হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

যেমন ছিল গোলাপগঞ্জ বাজারের দৃশ্যপট –  ঢাকাদক্ষিণে ৪ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। এমন খবর চাউর হলে গোলাপগঞ্জ বাজারেও শুরু হয় উত্তাপ। বেলা তখন দুপুর প্রায় ২ টা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি হিসেবে গোলাপগঞ্জ এমসি একাডেমিতে জড়ো হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। অপরদিকে গোলাপগঞ্জ পৌরসভার প্রধান ফটকের সামনে, রাজমহলের পাশে আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে দেশীয় অস্ত্র-আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমসি একাডেমি মাঠ থেকে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে চৌমুহনীতে যায়। এসময় হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা দেখে থমকে যায় প্রতিহতকারীরা। হামলায় না জড়িয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকায় দেখা যায়। কিন্তু মূহুর্তেই খোলস পাল্টে ফেলে তারা।

মিছিলটি চৌমুহনী প্রদক্ষিণ করে থানার পাশে যাওয়া মাত্রই পিছন দিক থেকে পুলিশ সহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে তারা। রামদা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় তারা। এসময় দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এক পর্যায়ে প্রায় আধাঘন্টার জন্য চৌমুহনী দখলে নেয় আওয়ামী নেতাকর্মীরা। তবে বেশিক্ষণ ঠিকে থাকতে পারে নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিহত তাজ উদ্দিনের লাশ নিয়ে ঢাকাদক্ষিণ থেকে মিছিল সহকারে চৌমুহনীতে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী। এতে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেখে সঠকে পড়েন আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারা। এক পর্যায়ে ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায় আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের ক্যাডাররা। মাঠ পুরো দখলে নেয় ছাত্র-জনতা। মিছিলে মিছিলে, স্লোগানে স্লোাগানে তখন কম্পিত হয় গোলাপগঞ্জ চৌমুহনী। থানা থেকে গুলি ছুড়লে এক পর্যায়ে থানা অবরুদ্ধ করে আন্দোলনরতরা। এসময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। গুলিতে মিনহাজ আহমদ ও গৌছ উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন।

এছাড়াও ঘটনার পরদিন ৫ আগষ্ট নগরীর ক্বীন ব্রিজ এলাকায় মো. পাবেল আহমদ কামরুল (২৩) নামে গোলাপগঞ্জের আরও এক যুবক গুলিতে প্রাণ হারান। তিনি উপজেলার কানিশাইল গ্রামের মোঃ রফিক উদ্দিনের ছেলে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কামরুলসহ গোলাপগঞ্জের ৭জন বীর সন্তান প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। দেশের সার্বভৈৗমত্ব ঠিকিরে রাখতে তাদের জীবন উৎসর্গ করলেও এখনো বিচার পায়নি শহীদ পরিবারগুলো।

শহীদ পরিবারের স্বজনরা বলছেন, ঘটনার এক বছর পূর্ণ হলেও এখনো ঘটনার সাথে জড়িতরা রয়ে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অদৃশ্য কারণে আসামীদের গ্রেপ্তার করা হয় নি। দ্রুত আসামীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা।

শহীদ জয় আহমদ এর ভাই মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার ভাইসহ গোলাপগঞ্জের ৭ জনকে হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। ৭ শহীদের নামে গোলাপগঞ্জ চৌমুহনীতে একটি চত্বর নির্মাণের দাবি জানাই আমরা’।

শহীদ পরিবারের পক্ষে মিনহাজ আহমদের পিতা আলা উদ্দিন বলেন, ‘গত ৪ আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশ বিজিবি ছাত্রলীগের পেটুয়া বাহিনীর গুলিতে আমার ছেলে শহীদ হয়। সে আমার পরিবারের সবার ছোট সন্তান এবং সবার মধ্যমনি ছিলো। হাস্যরসাত্মক কথাবার্তায় সে সব সময় আমাদের আনন্দে মাতিয়ে রাখতো। সে শহীদ হওয়ার পর আমাদের পরিবারের সবাই হতাশার মধ্যে জীবন যাপন করছি। তার মৃত্যু আমরা এখনো মেনে নিতে পারি না’। তিনি বলেন, ‘আফসোসের বিষয় হলো মামলা করার পর এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয় নি। সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা এখনো আমরা জানি না। প্রথম প্রথম সকল রাজনৈতিক দলের মানুষ আমাদের খবর নিতো কিন্তু এখন আর কেউ আমাদের খোঁজ রাখে না। অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপর আমাদের অনেক আশা ছিল যে আমার ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার হবে কিন্তু সেটাও এখন অনিশ্চিত। আমাদের একটাই দাবি, জুলাই শহীদদের পরিবার যেন সুষ্ঠু বিচার পায় এবং অতিদ্রুত যেন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সরকার কাজ করে এটাই আমাদের চাওয়া। ’

জানতে চাইলে গোলাপগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মোল্যা বলেন, ‘মামলার অগ্রগতি বেশ ভালোই, জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। ৭টি মামলার মধ্যে আমাদের কাছে ২টি রয়েছে। বাকিগুলো পিবিআই দেখছে। শীগ্রই চার্জশীট ছাড়বো। আশাকরি অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারবো।’

গোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিলটন চন্দ্র পাল বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন সব সময় শহীদ পরিবারের পাশে আছে। তাদের আত্মত্যাগ কখনো ভূলার নয়। গোলাপগঞ্জ চৌমুহনীতে চত্বর নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় এ বিষয়ে প্রস্তাব রেখেছি। এটা যেহেতু সড়ক বিভাগের রাস্তা, শহীদ পরিবারের দাবির প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক স্যারের মাধ্যমে সড়ক বিভাগে স্মারকলিপি পাঠিয়েছি। স্মৃতি রক্ষার্থে চত্বর নির্মাণে আমরা একমত আছি। সড়ক বিভাগের পারমিশন নিয়ে চত্বর নির্মাণে সর্বাত্বক সহযোগিতা থাকবে।

তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ৩জন শহীদ পরিবারের বাড়ির সামনের রাস্তা পাঁকা করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও শহীদ মিনহাজের বাড়ির সামনের রাস্তা পাঁকা করণের জন্য ৫ লক্ষ টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। সামনে কাজ শুরু হবে। এবং ৩জন শহীদ পরিবারকে ঘর সংস্কারের জন্য ঢেউটিন প্রদান করেছি। উপজেলা প্রশাসন শহীদ পরিবারের সহযোগিতায় সব সময় পাশে রয়েছে।’ 

অপরদিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও আহতদের সুস্থতা কামনায় আজ (সোমবার) বিকেল ৩টায় উপজেলা মডেল মসজিদে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। পরদিন ৫ আগষ্ট সকাল সাড়ে ৯টায় উপজেলা অডিটোরিয়ামে তাদের ঘিরে স্মৃতিচারণ, দোয়া মাহফিল ও সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হবে।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.