সমাজ একটি পরিবারমালার মতো, যেখানে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বয়োজ্যেষ্ঠ পর্যন্ত সবাই একটি ধারাবাহিকতার অংশ। এই ধারাবাহিকতাকে সম্মানিত ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে হলে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অপরিহার্য। ইসলাম এমন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে একজন বৃদ্ধ মানুষ শুধু করুণার পাত্র নন; বরং তিনি সম্মানের অধিকারী। বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন শুধু সামাজিক সৌজন্য নয়; বরং তা ঈমান ও তাকওয়ার পরিচায়ক।আর সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে রয়েছে ইহকাল ও পরকালে এর উত্তম প্রতিদানে।
শ্রদ্ধা, সেবা ও বিনয়ে কোরআনের নির্দেশনা
যদিও কোরআনে সরাসরি “বয়োজ্যেষ্ঠদের” সম্মান প্রসঙ্গে বিশেষ শব্দে কোনো আয়াত নেই, তবে অনেক আয়াতে বয়স্ক, দুর্বল, অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি সদাচরণ, সহানুভূতি ও নম্রতার নির্দেশ এসেছে।
সুরা আল-ইসরা ২৩-২৪ আয়াতে আল্লাহ বলেন:
﴿ فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا ﴾
‘তুমি তাঁদের (পিতা-মাতা) প্রতি ‘উফ্’ শব্দটিও উচ্চারণ কোরো না, ধমকিও দিও না, বরং তাঁদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো।’
এখানে পিতা-মাতা মূলত সমাজের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতিনিধিত্ব করছেন।তাঁদের প্রতি এই সম্মান ও নম্রতার আদেশ সমগ্র বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রেণির প্রতি ইসলামি আচরণের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয়।
সুরা লুকমান ১৪ আয়াতে এসেছে:
﴿ وَوَصَّيْنَا الإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ ﴾
‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি।’
এই সদ্ব্যবহার শুধুমাত্র ভরণপোষণে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তার মধ্যে রয়েছে কথা, আচরণ, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা এবং সর্বোপরি হৃদয়ের নম্রতা।
বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান ও তার পুরস্কারে হাদিসের নির্দেশনা
মানবতা আর সাম্যের অগ্রদূত আখেরী নবী মুহাম্মদ (সা.) বারংবার বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান ও ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছেন এবং তা উপেক্ষাকারীকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন।
১. বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান প্রদর্শন আল্লাহর সম্মানের নামান্তর
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
«إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ اللَّهِ تَعَالَى إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ»
“নিশ্চয়ই মুসলমান বয়োজ্যেষ্ঠের সম্মান করা আল্লাহর সম্মানের অন্তর্ভুক্ত।”
(আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৪৩) অর্থাৎ, একজন বৃদ্ধ মুসলমানের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করা হয়, তা আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ যেন নিজেই সে সম্মানের প্রতিদান দেন।
২. বড়দের সম্মানে পরবর্তীতে প্রতিদান মিলে
রাসূল (সা.) বলেন:
«مَنْ وَقَّرَ شَيْخًا فِي سِنِّهِ، بَعَثَ اللَّهُ لَهُ مَنْ يُوَقِّرُهُ عِنْدَ سِنِّهِ»
‘যে ব্যক্তি বয়সে বৃদ্ধ কাউকে সম্মান করে, আল্লাহ তাকে এমন কাউকে দান করবেন যে তার বৃদ্ধকালে তাকে সম্মান করবে। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস: ৪৯৪৩)
বুঝা গেল যে, এটি একটি নিশ্চিত ও ধারাবাহিক সামাজিক প্রতিদানব্যবস্থা।
যেখানে সম্মান করা হলে পরবর্তী প্রজন্ম থেকে সম্মান ফিরে পাওয়া যায়।
৩. বড়দের সম্মান না করা ঈমানের পরিপন্থী
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
«لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا، وَيُوَقِّرْ كَبِيرَنَا»
‘সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না।’ (তিরমিজি, হাদিস, ১৯২০)
এ হাদিসে “لَيْسَ مِنَّا” অর্থাৎ “সে আমাদের দলভুক্ত নয়” একটি ভয়াবহ সতর্কবার্তা। এর দ্বারা বোঝা যায়, বড়দের অসম্মান করা ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুতি।
মনীষীদের দৃষ্টিতে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান
জ্ঞানের দরজা উপাধীদে ভুষিত সাহাবি আলী (রা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করে, সে কখনো নিজের সম্মান হারায় না।’ ইমাম শাফিয়ী (রহ.) বলেন: ‘তোমরা যখন কাউকে সম্মান করো, তখন আসলে নিজেকেই সম্মান করো; কারণ মানুষ তার আচরণের প্রতিচ্ছবিতে প্রতিফলিত হয়।’ ইবনু কাইয়্যিম (রহ.) বলেন: ‘সমাজে যদি যুবক শ্রেণি বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে শেখে, তবে সে জাতি মদীনার মত শান্ত ও সুশৃঙ্খল সমাজে পরিণত হয়।’ (আল-ফাওয়াইদ, পৃষ্ঠা: ১৭৩)
সমাজ ও পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মানের সুফল
১. পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। ২. বিবাহিত জীবনে স্থিতি আসে, কারণ সন্তানরা পিতামাতার অবদান বুঝতে শেখে। ৩. নতুন প্রজন্ম মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়। ৪. বয়স্করা সমাজে অবহেলার শিকার না হয়ে হয়ে ওঠেন সম্মানিত ও দায়িত্বশীল।
একটি জাতির নৈতিক শক্তি নির্ভর করে তার ভেতরে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের উপর। যেখানে বৃদ্ধ ব্যক্তি অসম্মানিত হন, সেখানে মূল্যবোধ নষ্ট হয়, সমাজে অহংকার বাড়ে এবং আল্লাহর রহমত হ্রাস পায়।
আসুন, আমরা আমাদের পরিবারে, সমাজে ও কর্মস্থলে শব্দ চয়নে, আচরণে ও সেবায় বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি। কারণ এই সম্মান শুধু একজন মানুষকে নয়, আল্লাহকেই সম্মান করা। আর যার প্রতিদান মিলে দুনিয়াত ও আখিরাত উভয় জাহানে।
✍🏻 মুফতি সাইফুল ইসলাম
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.