আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি জোরেসোরে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে প্রশাসনেও। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট করার লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এসপি ও ইউএনও পদে দায়িত্ব পালনের জন্য সৎ, যোগ্য ও সাহসী কর্মকর্তা খোঁজা হচ্ছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দিয়ে একটি বিতর্কমুক্ত তালিকা তৈরি করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আগামী নভেম্বরের মধ্যেই বাছাই করা তালিকা থেকে লটারির মাধ্যমে পদায়ন করা হতে পারে বলে জানা গেছে। বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নবিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি সাংবাদিকদের জানান, তফসিলের আগেই সব জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) লটারির মাধ্যমে পদায়ন করা হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনের সময় মাঠ প্রশাসনের জেলা প্রশাসক পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডিসিরাই ভোটের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। তাই ডিসি পদে দক্ষ, নিরপেক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাদের পদায়নের বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। তফসিলের আগে নভেম্বরের মধ্যেই মাঠ প্রশাসনে রদবদল শেষ করতে চায় সরকার। সে লক্ষ্যে ডিসি, এসপি, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) তালিকা তৈরি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিকসহ বিভিন্ন তথ্য নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাই চলছে। বিশেষ করে ডিসি পদায়নের ফিটলিস্ট তৈরি করা হয়েছে সতর্কতার সঙ্গে। এর আগে ডিসি নিয়োগ নিয়ে নানান বিতর্ক ওঠায় এবার ডিসি পদায়নের চূড়ান্ত তালিকা তৈরির সাক্ষাৎকার দীর্ঘ সময় ধরে নেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ডিসি হিসেবে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ২২ কর্মকর্তাকে ফেব্রুয়ারিতে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা তৎকালীন ৩৩ ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে।
একইভাবে যারা এসপির দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরও বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি করা হয়েছে। এ ছাড়া বিগত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এসব কারণে এবার অনেক কর্মকর্তাই নির্বাচনকালীন ডিসি, ইউএনও এবং এসপি হওয়ায় আগ্রহী নন বলে জানা গেছে। তাই এবার অবাধ ভোট করতে সৎ, নিরপেক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তাও খোঁজা হচ্ছে, যাতে ভোটের সময় তারা কোনো রাজনৈতিক বা কোনো মহলের চাপের কাছে নত না হন।
গত ২০ মার্চ ১৯৬ জন উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার। তাদের মধ্যে ২১ জন ডিসি ছিলেন। কিন্তু যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া ডিসিদের এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি। সূত্র জানায়, এই ২১ ডিসি ও ২৪তম বিসিএস ব্যাচের পাঁচ ডিসিকে পদ থেকে প্রত্যাহার করতে জনপ্রশাসন-বিষয়ক কমিটির কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলে এ বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, সামনে নির্বাচন। তাই একসঙ্গেই সবাইকে প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আগামীতে মাঠ প্রশাসনে ডিসিদের উঠিয়ে আনা এবং নতুন ডিসি পদায়নের ক্ষেত্রে নির্বাচনের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে।
বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, যুগ্মসচিব ও তার ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতে অর্থ উপদেষ্টাকে প্রধান করে গত ৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন-বিষয়ক কমিটি করে সরকার। এ কমিটির সুপারিশের আলোকে মাঠ প্রশাসনে পদে রদবদল করা হবে। বর্তমানে ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২৫ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৩ কর্মকর্তা ডিসির দায়িত্বে আছেন। ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ডিসি নিয়োগ দিতে তাদের ফিটলিস্টও তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট মাঠ প্রশাসনের সব পদায়ন-বদলির একক এখতিয়ার থাকবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। এ কারণে তফসিলের আগেই পদায়ন শেষ করবে সরকার।
বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, যুগ্মসচিব ও তার ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতে অর্থ উপদেষ্টাকে প্রধান করে গত ৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন-বিষয়ক কমিটি করে সরকার। এ কমিটির সুপারিশের আলোকে মাঠ প্রশাসনে পদে রদবদল করা হবে। বর্তমানে ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২৫ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৩ কর্মকর্তা ডিসির দায়িত্বে আছেন। ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ডিসি নিয়োগ দিতে তাদের ফিটলিস্টও তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট মাঠ প্রশাসনের সব পদায়ন-বদলির একক এখতিয়ার থাকবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। এ কারণে তফসিলের আগেই পদায়ন শেষ করবে সরকার।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান বলেছেন, এবার নির্বাচনের সময় কোনো দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকছে না। ফলে নির্বাচন সামনে রেখে যে রদবদল করা হবে তার সঙ্গে দলীয় সরকারের সম্পর্ক না থাকায় এটাকে মাঠ প্রশাসন সাজানো বলা যাবে না। কারণ মাঠ প্রশাসন সাজানোর ব্যাপার তখনই আসে যখন দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকে। দলীয় সরকারের সময় প্রতিপক্ষ অন্যান্য রাজনৈতিক দল মনে করে ক্ষমতাসীনরা সুবিধা নেওয়ার জন্য প্রশাসন সাজায়, অতীতে এ রকম হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান বলেন, নির্বাচনের আগে সৎ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হবে। এবার বিতর্কহীন তালিকা তৈরির সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। যখন যে জেলায় প্রয়োজন হবে সেখানে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, যাতে বিতর্কের সুযোগ না থাকে সে জন্য খুব নিবিড়ভাবে বাছাই করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে অতীতে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে পেশাদার ও সর্বোচ্চ যোগ্য লোককে বাছাই করা হচ্ছে।
এদিকে তফসিলের আগে সব জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) লটারির মাধ্যমে পদায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তবে তফসিলের পর নির্বাচন কমিশন যদি কাউকে বদলি ও পদায়নের প্রয়োজন মনে করে, তারা সেটা করবে।
বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নবিষয়ক বৈঠক শেষে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন সেখানে তিনি বলে দিয়েছেন নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। তারই ধারাবাহিকতায় তারা বৈঠক করেছেন এবং এই মিটিংয়ে নির্বাচনের সময় যে লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন হবে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় দেখা যায় প্রার্থীরা তার আসনে পছন্দের এসপি, ডিসি কিংবা ওসিকে চান। কিন্তু আমরা এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি গণমাধ্যমকে ডেকে সবার সামনে এসপি ওসি পদায়নে লটারি করব। ডিসি ও ইউএনও যেহেতু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন, সেখানে লটারির মাধ্যমে পদায়ন হবে কি না, তারা সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তিনি আশা করছেন, তারাও লটারি মাধ্যমে পদায়ন করবে।
তিনি বলেন, ওসির সংখ্যা যেহেতু বেশি, তাই একটি বিভাগ ধরে ধরে লটারির মাধ্যমে পদায়ন করা হবে। এবারের নির্বাচনে ৪৭ হাজার কেন্দ্রে একটি করে বডি ক্যামেরা থাকবে। ওই কেন্দ্রে পুলিশের জ্যেষ্ঠ সদস্যের কাছে বডি ক্যামেরা থাকবে। পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৮ লাখ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। যারা নির্বাচনে দায়িত্বে থাকবেন, তাদের প্রত্যেককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যিনি যে বাহিনীর, যার যার এলাকা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.