সিলেটে প্রতিদিন বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ক্রমবর্ধমান করোনা সংক্রমণে গত কয়েকদিনে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ। হঠাৎ রোগী বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) পূর্ণ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে এই হাসপাতালের আইসিইতে একটি শয্যাও খালি নেই।
গত বছরের ৫ এপ্রিল সিলেটে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। প্রথম দিকে সংক্রমণের হার কম থাকলেও মে-জুনে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ জন করে শনাক্ত হতে থাকেন। সে সময় শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার সঙ্কট দেখা দেয়। এরপর শয্যার সংখ্যা বাড়ানো হয়। বর্তমানে হাসপাতালের ১৬টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ১২টি চালু আছে।
মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালের দেওয়া তথ্যমতে সব আইসিইউ বেডেই রোগী ভর্তি রয়েছেন। নগরের আরও দুইটি বেসরকারি হাসপাতালেও চলছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা। সেসব হাসপাতালের আইসিইউতেও বেড়েছে চাপ। বর্তমানে বেসরকারি এই দুই হাসপাতালে মাত্র তিনটি আইসিইউ বেড খালি রয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে যারা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন তাদের একটি বড় অংশের অক্সিজেনসহ আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হচ্ছে। তাই চাপ বেড়েছে আইসিইউতে।
সিলেট করোনা আইসোলেশন সেন্টার শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. সুশান্ত কুমার মহাপাত্র বলেন, ‘বর্তমানে ১২টি আইসিইউ বেড আছে। কিন্তু একটিও খালি নেই। অনেকে হাসপাতালে এসে আইসিইউ শয্যা খালি আছে কি না খোঁজ নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।’ বর্তমানে হাসপাতালে আসা রোগীদের বেশিরভাগেরই অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
হাসপাতালের সাধারণ শয্যাও প্রায় পরিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন সুশান্ত মহাপাত্র। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে আইসিইউসহ ৯৭টি শয্যা রয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিলেন ৮৭ জন। ফেব্রুয়ারিতে সাধারণত প্রতিদিন ১৫-২০ জনের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন না। কিন্তু মার্চের শেষ দুই সপ্তাহে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে।’
মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ইনচার্জ ফজলে রাব্বি জানান, এই হাসপাতালে বর্তমানে ৮টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে খালি রয়েছে মাত্র একটি। গত দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য রাখা ৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে বর্তমানে মাত্র দুইটি খালি রয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সিলেটে করোনার সংক্রমণ দ্র্রুত বাড়ছে। গত অক্টোবরে সিলেট বিভাগে শনাক্ত হয়েছিলেন ৯৯৪ জন। এরপর নভেম্বরে ৯১৩ জন, ডিসেম্বরে ৮১৪ জন ও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রায় অর্ধেক কমে শনাক্ত হন ৪৮১ জন। ফেব্রæয়ারি মাসে শনাক্ত আরও কমে দাঁড়ায় ২৯২ জনে। কিন্তু মার্চে এসে আবারও বাড়তে থাকে শনাক্তের সংখ্যা। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মার্চ মাসে শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৮ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে শনাক্ত হয়েছেন ৩৫ জন। গত ১ সপ্তাহে সিলেট বিভাগে শনাক্ত হয়েছেন ৪৮০ জন। গড়ে প্রতিদিন ৬৮ জন করে শনাক্ত হচ্ছেন।
তিন কারণে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্যে পরিবর্তিত ধরন বা ইউকে ভেরিয়েন্ট এখানে দ্রুত ছড়াচ্ছে। এই সময়ে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করছে উষ্ণ আবহাওয়াও। স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য করে অবাধ চলাফেরাও ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
সিলেটসহ দেশের ২৯টি জেলা করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সম্প্রতি জানানো হয়েছে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশের যেসব জেলায় সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের বেশি সেগুলোকেই মূলত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।’
এ অবস্থায় এখনই কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘বিদেশযাত্রীদের মাধ্যমে সিলেটসহ সারাদেশে ইউকে ও স্প্যানিশ ভেরিয়েন্টসহ করোনার নতুন ধরন ছড়াচ্ছে। বর্তমানে রোগীদের বেশিরভাগই ইউকের স্ট্রেইনে (ধরন) আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের উপসর্গও বেশি। বেশিরভাগ রোগীকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে, অক্সিজেন-আইসিইউ সাপোর্ট লাগছে।’
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সাধারণ মানুষকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে; বাইরে গেলে মাস্ক পরিধান করতে হবে বলে মনে করেন হিমাংশু লাল রায়। তিনি বলেন, ‘এখনই সতর্ক না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।’ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আইসিইউ পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় এখনই আইসিইউ, সাধারণ শয্যাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে প্রশাসনকে সর্তক হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।