দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাত্রা আরও তীব্র হচ্ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে শনাক্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। রোগী বাড়ায় দেশের হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ হাসপাতালে চাহিদানুযায়ী ডাক্তারসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নেই। জেলা-উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সের অভাব তীব্র। এর সঙ্গে আছে আইসিইউ, অক্সিজেন এবং ওষুধের সংকট। এসব কারণে রোগীরা যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
হাসপাতালে সিট পাচ্ছেন না। মেঝেতে রাখা হলেও ডাক্তার আসছেন না। প্রয়োজন হলে রোগীকে অক্সিজেন দেওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার জন্য রোগী ও তাদের স্বজনরা হাহাকার করছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেক সময় জীবন বাঁচাতে রোগী মেঝেতে রেখেও চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রাজধানী বা বিভাগীয় শহরগুলোর বাইরে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা আরও শোচনীয়। কাজেই জীবন বাঁচাতে রোগীরা উপজেলা থেকে জেলায় এবং জেলা থেকে রাজধানীর দিকে ছুটে আসছেন। এ কারণে ঢাকার কোনো কোনো হাসপাতালে শয্যার তুলনায় অতিরিক্ত রোগীর সেবা দেওয়া হচ্ছে। তারপরেও সবার ভাগ্যে জুটছে না কাঙ্ক্ষিত শয্যা। মঙ্গলবার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১৪৯২৫ জন, মারা গেছেন ২৫৮ জন। এর আগের দিন শনাক্ত ১৫ হাজার ১৯২ এবং মৃত্যু হয়েছে ২৪৭ জনের। রোববার শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ২৯১, মারা গেছেন ২২৮ জন। এমন পরিস্থিতিতে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট কোভিড ডেডিকেটেড শয্যা আছে ১৫ হাজার ৭১৯টি। এর মধ্যে কাগজে-কলমে খালি আছে ৫৬৭৬টি। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। যেসব হাসপাতালের শয্যা খালি রয়েছে সেগুলোতে মূলত চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। ফলে দেশজুড়ে একধরনের হাহাকার চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কোভিড পরিস্থিতি এক প্রকার অনিয়ন্ত্রিত। সংক্রমণের হার কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। ফলে মৃত্যুও কমছে না। তাই রাজধানীসহ দেশের প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরে অন্তত একটি করে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা জরুরি বলে তারা মনে করছেন। যেখানে সব শয্যায় অক্সিজেনের নিশ্চয়তা থাকবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে কোভিড রোগীর নির্ধারিত শয্যা সংখ্যা ৭২২৫টি, এর মধ্যে কাগজে-কলমে খালি আছে ২১৮৩টি; চট্টগ্রাম বিভাগে শয্যা আছে ২৭৭০টি, খালি আছে ১২১১টি; রাজশাহী বিভাগে শয্যা আছে ১৪৬৬টি, খালি আছে ৪৪৪টি; রংপুর বিভাগে শয্যা ১০৪১টি, খালি ৫৪২টি; খুলনা বিভাগে শয্যা ১৬৯১টি, খালি আছে ৮৪১টি; বরিশাল বিভাগে শয্যা ৬২০টি, খালি ৮৫টি এবং সিলেট বিভাগে শয্যা ৪৩০টি, খালি আছে ২০৭টি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্য দেখা যায়, ২৬ জুলাই রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে শয্যা ১৬৯টি, খালি ৬; কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শয্যা ২৭৫, সেখানে অতিরিক্ত ভর্তি আছেন ৮৬ রোগী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা ৭০৫, খালি ৮টি; শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা ২৬৩টি, খালি আছে ৪৬টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শয্যা ২৩০টি, খালি আছে ২০টি। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে শয্যা ৩০০টি, খালি ১৭টি; চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে শয্যা ১৪০টি, খালি ২টি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা ২১০টি, খালি ৬টি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা ৪৩৪টি, খালি ৫৫টি। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা ২৩০, খালি ৭টি। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৭৮টি, খালি ১৭টি; বরগুনা সদর হাসপাতালে ৫০ শয্যার বিপরীতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ৬৭ জনকে। সিলেটে শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতালে শয্যা ৮৪টি, খালি আছে ৫টি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব হাসপাতালে কয়েক দফা সাধারণ ও আইসিইউ শয্যাও বাড়ানো হয়েছে। তারপরেও সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৯টি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। রাজধানীতে চিকিৎসাধীন কোভিড রোগীর ৭৫ শতাংশই আসছে ঢাকার বাইরে থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোভিড মহামারির শুরু থেকেই দেশের বৃহৎ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হয়। ওই সময় ৫৮০ শয্যা কোভিড রোগীদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে রোগী বাড়লে এর সঙ্গে আরও ২০০ শয্যা যুক্ত করা হয়। কোভিড রোগীদের চিকিৎসার বাইরে রেফারকৃত জরুরি সার্জারির রোগী ও নবজাতক রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি পর্যায়ে রাজধানীর আরেকটি বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই হাসপাতালটিও কোভিড ডেডিকেটেড অর্থাৎ এটি কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত। ৮৫০ শয্যার এই হাসপাতালের ৫০০ শয্যায় কোভিড রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। এই শয্যাগুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেনের লাইন সংযোগ দেওয়া আছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীসহ বড় শহরের হাসপাতলে রোগীর চাপ বেশি। আবার অনেক জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে রোগী যাচ্ছে না। অনেকে বাসায় অক্সিজেন নিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করছে। এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে ফিল্ড হাসপাতাল বাড়াতে হবে। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন জরুরি। এছাড়া বিভাগীয় পর্যায়ে সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে ফিল্ড হাসপাতাল দ্রুত স্থাপন করতে হবে। অন্যথায় কোভিড ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
এদিকে জেলা ও উপজেলা থেকে রোগীরা কেন ঢাকামুখী জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূলত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর তীব্র সংকট রয়েছে। এতে ওইসব হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয় না। কিন্তু উপরের নির্দেশে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ফলে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই জীবন বাঁচাতে তারা বিভাগীয় শহর বা রাজধানীর দিকে ছুটে আসছেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এইচআরএম ইউনিটের এইচআরএইচ ডেটা শিট ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে জনবল সংকটও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এক বড় অন্তরায়। দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য আছেন ৩ দশমিক ৮ জন চিকিৎসক এবং ১ দশমিক ৭ জন নার্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আমাদের মতো দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের মোটামুটি মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রী মিলে থাকতে হবে ২৩ জন। কিন্তু আমাদের আছে মাত্র ৮ দশমিক ৩ জন। পাশের দেশ ভারতে ১৮ দশমিক ৫, ভুটানে ১৯ দশমিক ৩, থাইল্যান্ডে ২৮, নেপালে ৩৩ দশমিক ৫, শ্রীলঙ্কায় ৩৬ দশমিক ৮ আর মালদ্বীপে ১১৮ জন। অপরদিকে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে ৩ জন নার্স ও ৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী থাকার কথা। কিন্তু আমাদের আছে দশমিক ৩ জন নার্স আর দশমিক ৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী। এই স্বল্প জনবলের মধ্যেও আবার ২০১৯ সালে ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ পদই শূন্য ছিল (এইচআরএইচ ডেটা শিট ২০১৯; এইচআরএম ইউনিট, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়)। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে জনবল সংকটও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এক বড় অন্তরায়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, যেভাবে রোগী বাড়ছে তাতে হাসপাতালে শয্যা সংকট দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ শয্যায় রোগীতে ভর্তি হয়ে আছে। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত হচ্ছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে চালু করতে পারব। আশা করছি আগামী শনিবার থেকে আমরা রোগী ভর্তি করতে পারব।
সূত্রঃ যুগান্তর