মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বনি ইসরাঈলের বহু অপকর্ম ও অবাধ্যতার বিবরণ দিয়েছেন। যুগে যুগে তারা কেবল নবী-রাসুলদের অমান্য করেনি, বরং বহু নবীকে হত্যাও করেছে। তাদের মধ্যে জন্মেছে মুনাফিকি, চক্রান্ত ও স্বার্থপরতার এমন ভয়াবহ সংস্কৃতি, যা মানবসভ্যতার জন্য অনন্ত সংকটের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইহুদিদের চক্রান্তের সূচনা
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ইহুদিদের ইতিহাস শুরু হয় নবী মুসা (আ.)-এর সময় থেকে।আল্লাহ তাদের ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি দিলেন। অথচ সেই জাতিই পরে মূর্তিপূজায় লিপ্ত হলো, নবীদের অমান্য করল, আল্লাহর বিধানের সঙ্গে উপহাস করল। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এবং যখন আমরা তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম এবং তুর পাহাড়কে তোমাদের ওপর তুলে ধরলাম। তোমরা দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, যা আমি তোমাদের দিয়েছি।তার পরও তোমরা তা অমান্য করলে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৬৩)
নবী মুসা (আ.)-এর অনুপস্থিতিতে তারা গরুর মূর্তি বানিয়ে পূজা শুরু করে। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৫১)
মহান আল্লাহ ইহুদি জাতির অবাধ্যতার কথা উল্লেখ করে আরো বলেন, ‘তোমরা কি আবারও নিজেদের কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করবে আর কিছু অস্বীকার করবে? যারা তা করে, তাদের শাস্তি দুনিয়াতে লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তি।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৮৫)
নবীদের হত্যা ও চক্রান্ত
ইহুদিরা তাদের বহু নবীকে হত্যা করেছে।মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি পূর্বে তোমাদের নবীদের হত্যা করোনি?’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৯১)
তাদের মধ্যে হত্যার সংস্কৃতি এমনই ব্যাপক যে কোরআন বলে, ‘তারা (ইহুদিরা) বলেছিল, আমাদের অন্তর মোড়ানো, বরং আল্লাহ তাদের কুফরির জন্য তাদের অভিশাপ দিয়েছেন।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৮৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিরুদ্ধে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর মুনাফিক ও ইহুদিদের অপতৎপরতা নতুন মাত্রা পায়। তারা মদিনার ভেতর থেকে মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার চেষ্টা করে, নাফাকতের মাধ্যমে মুসলমানদের শত্রুপক্ষকে সহায়তা করে এবং সরাসরি যুদ্ধের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, বিশেষ করে বানু কাইনুকা, বানু নাজির ও বানু কুরাইজা গোত্র সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা করে। বানু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে কোরআনের ভাষ্য হচ্ছে, ‘আর আল্লাহ তাদের হৃদয়ে সন্ত্রাস সঞ্চার করেন; ফলে তারা নিজেদের ঘরে ঘরে তাদের প্রাসাদগুলো নিজেরাই ভেঙে দেয় এবং মুসলমানদের হাতেও ভাঙন ঘটে।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২৬-২৭)
ইসলামের খিলাফতের যুগ পেরিয়ে যখন মুসলিম উম্মাহ রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হতে থাকে, তখন ইহুদিবাদীরা আরো বেশি সক্রিয় হয়।
উসমানি খিলাফতের পতনের পেছনে তাদের ষড়যন্ত্র আজ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, বিশেষ করে সায়েকস-পিকট চুক্তি, বেলফোর ঘোষণা (১৯১৭) এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা (১৯৪৮)। এর সব কিছুতেই ইহুদিবাদী লবির কৌশল সুস্পষ্ট।
বেলফোর ঘোষণা ছিল মূলত ব্রিটিশ সরকারের এক ম্যানিপুলেশন, যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভূমিকা নেওয়া হয়। এই পরিকল্পনার গভীরে ছিল রথসচাইল্ড পরিবারের মতো ইহুদি অর্থলবির প্রভাব।
ইহুদিবাদী আধুনিক অপতৎপরতা : বর্তমানে ইহুদিবাদ শুধু অর্থনীতি নয়, প্রযুক্তি, মিডিয়া, শিক্ষা, বিনোদন ইত্যাদি প্রতিটি সেক্টরে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে। তাদের মূলনীতি Divide and Rule। মুসলিম বিশ্বে বিভেদ, ফিতনা, গৃহযুদ্ধ, দুর্নীতির নেপথ্যে বারবার উঠে আসে এই গোষ্ঠীর নাম। অথচ কোরআন পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে যে ‘তুমি দেখবে, মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর শত্রুতা করে ইহুদি ও মুশরিকরা।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৮২)
কিন্তু মুসলমানরা নিজেদের প্রকৃত শিক্ষা ভুলে গিয়ে আজ ইহুদিবাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়ে আছে। ফিলিস্তিনে গাজার নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, ইরাক-সিরিয়ার ধ্বংস, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অস্থিতিশীলতা—সব কিছুর পেছনে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ইহুদিবাদের হাত রয়েছে।
ইহুদিবাদের এই নোংরা অপতৎপরতা বিশ্বের সর্বত্র চলমান। তাই মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া, সচেতন থাকা এবং ইসলামী ঐক্য বজায় রাখা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
মুসলিম উম্মাহ একদিন অবশ্যই বিজয়ী হবে, কারণ মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য; কিন্তু তার জন্য চাই ঈমান, ঐক্য ও হিকমতপূর্ণ নেতৃত্ব।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কোরআন ও সুন্নাহ প্রদর্শিত পথ ও মতের ভিত্তিতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেণ গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
✍🏻 মুফতি সাইফুল ইসলাম
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.