‘বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে, তার ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৪৭ বছর পার হলেও মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকায় আমার নাম ওঠেনি। সংসার চালাতে হয় স্ত্রীর ভিক্ষা করা টাকায়। মরার আগে হলেও অন্তত মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকায় নিজের নামটা দেখতে চাই’।
আবেগাপ্লুত হয়ে এমনটিই বললেন মহম্মদপুর উপজেলার পাল্লা গ্রামের ৯২ বছরের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেম শেখ। বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হাসেম শেখ উপজেলার দীঘা ইউনিয়নের পাল্লা গ্রামের মৃত আব্দুল জব্বার শেখের ছেলে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্ববানে সাড়া দিয়ে ৮ নম্বর সেক্টর বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন তিনি।
সে সময় আঞ্চলিক বাহিনীর অধিনায়ক গোলাম ইয়াকুবের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে একাধিকবার সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন আবুল হাসেম।
পরে তিনি মহম্মদপুরের আহম্মদ-মহম্মদ বাহিনীতে যোগদান। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিজের নৌকায় করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা-নেওয়া, তাদের গোলাবারুদ বহনসহ মুক্তিযোদ্ধাদের পাহারা দিয়ে রাখতেন আবুল হাসেম। যার মুক্তি বার্তা নম্বর (০৩)। 
স্বধীনতার পরবর্তীতে ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে তিনি আবেদন করেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বিকৃতি পাবার জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মো. আবুল হাসেম শেখের নাম আজো মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান পায়নি। 
সরেজমিন শনিবার দুপুরে মো. আবুল হাসেম শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন আঞ্চলিক বাহিনীর অধিনায়ক মো. গোলাম ইয়াকুব (বীর প্রতীক), মাগুরা জেলা ইউনিটের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোল্লা নবুয়ত আলী, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমান্ডার আলী রেজা খোকন ও ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল গফুর মোল্লার সাক্ষরসহ তার মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়ন পত্র। একাধিক দফতরের সনদ তার সংগ্রহে থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠেনি আবুল হাসেমের। তারপরও তিনি পরম মমতায় সেগুলো বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবার জন্য। 
তাই তিনি সমকাল প্রতিবেদকের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবি জানান, মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নামটা তিনি যেন দেখে যেতে পারেন। আবুল হাসেম শেখ বলেন, জায়গা জমি নাই। মাত্র ২ শতক জমির উপর একটি দুচালা টিনের ঘর। চলা-ফেরা করতে পারি না। বৃদ্ধা স্ত্রী মহিরণ নেছা ভিক্ষা করে যা পান তা দিয়েই চলে সংসার। 
তিনি অভিযোগ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য আমাদের ইউনিয়ন কমান্ডার আব্দুল গফুর মোল্লা ছয় বছর আগে সাড়ে ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু আজও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি। আর সেই টাকাও ফেরত দেননি গফুর মোল্লা।
আবুল হাসেম আরও অভিযোগ করেন, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান আমার চেক বই নিয়ে আমার নামে আসা অনুদানের ৩৬ হাজার টাকা তুলে আমাকে মাত্র ৮ হাজার টাকা দিয়েছেন। 
তবে ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল গফুর মোল্লা ও চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। মহম্মদপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (সাবেক) আলী রেজা খোকন বলেন, আমি জানি আবুল হাসেম একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে মহম্মদপুরে সংগঠিত বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
কিন্তু কেন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নাম ওঠেনি সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানে না বলে জানান।মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান শনিবার দুপুরে এই মুক্তিযোদ্ধার করুণ অবস্থার কথা জানতে পেরে তার বাড়িতে যান। এ সময় তাকে দেখে আবুল হাসেম আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কথাসহ বর্তমান সময়ের অস্বচ্ছল সংসারের করুণ কাহিনী অশ্রুসিক্ত হয়ে নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানান। 
এ সময় নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান এই অসহায় মুক্তিযোদ্ধাকে জানান, সরকারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই প্রকিয়া স্থগিত রয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে আপাতত কিছু করার নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন-২ প্রকল্প থেকে বাড়ি বানানোর যে বরাদ্দ চালু আছে তার থেকে একটা বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *